প্রতিটি মানুষকে একটি জীবন দিয়ে তাকে কিছুটা সময় এই পৃথিবীতে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কাজের জন্যে এই একটিই জীবন। এই জীবনে আমরা উৎকৃষ্ট কাজও করি আবার নিকৃষ্ট কাজও করি। ভালো কাজ অর্থাৎ সৎকর্ম যেমন স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক, তেমনি মন্দ কাজ বা অপকর্ম আমাদের প্রতি স্রষ্টার অসন্তুষ্টির কারণ। যে ভালো করবে সে অনুসারে সে পুরস্কৃত হবে আর যে মন্দ করবে সে অনুসারে করুণ পরণতি ভোগ করব। অর্থাৎ ভালো করলে ভালো, মন্দ করলে মন্দ পরিণতি। স্রষ্টা আসলে জীবন সৃষ্টি ও মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন শুধুমাত্র পরীক্ষা হিসেবে। সূরা মূলক এর ২ নম্বর আয়াতে স্রষ্টার মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেন, ’তোমাদের মধ্যে সৎকর্মে কে অগ্রগামী তা পরীক্ষার জন্যেই তিনি জীবন সৃষ্টি ও মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন।’
একবার রাসুল (স)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি বলেছেন, …..যে র্দীঘজীবন পেয়ে সৎর্কম করেছে …..আর নিকৃষ্ট কে? …..যে র্দীঘজীবন পেয়ে কুর্কম করছে। আসলে প্রতিটি কাজের জন্যে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং এর প্রতিফল আমাদরেকইে ভোগ করতে হব। কিছু কাজের প্রতিফল আমরা এ জীবনেই পেয়ে থাকি। আর কিছু কাছের প্রতিফল দেয়া হবে পরের অনন্ত জীবনে, যে জীবনে সবারই যেতে হবে।
নিশ্চিত সে জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নেয়াই প্রজ্ঞাবানের কাজ। সে প্রস্তুতির জন্যে চাই পুঁজি বিনিয়োগ। যে কোন ব্যবসায়ের জন্যই পুঁজি বিনিয়োগ প্রয়োজন। পরকালীন জীবনের প্রস্তুতির জন্যে প্রয়োজন সময় নামক পুঁজির সঠিক বিনিয়োগ। সময়কে যত বেশি ভালো কাজে, ভালো চিন্তায় বিনিয়োগ করা যাবে, পরকালের সাফল্যের প্রস্তুতি ততো ভালো হবে। কিন্তু সময় কারো অফুরন্ত নয়। জীবন খুব ছোট। যেকোন সময় জীবনের সমাপ্তি ঘটতে পারে। জীবনের সমাপ্তি মানেই আরেক অনন্ত জীবনের শুরু। কিন্তু প্রস্তুতি?
ধরুন আপনি ব্যবসার কাজে ৩ দিনের জন্যে চট্টগ্রাম যাবেন।তার জন্যে আপনার কত ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন, কতদিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। লাগেজে এটা, ওটা নিতে নিতে এক সময় লাগেজের চেইন আটকানোই কঠিন হয়ে যায়। তারপরও প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নেয়া হয়না, অনেক প্রস্তুতিই বাদ থেকে যায়। এই যদি হয় মাত্র ৩ দিনের জন্যে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি, অনন্ত কালের যাত্রার জন্যে প্রস্তুতি কী হওয়া প্রয়োজন? আবার চট্টগ্রামে ব্যবসার কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে বাসার সাথে মোবাইলে যোগাযোগ রক্ষা করছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন, ওখানে থেকেই ঢাকার অফিস ম্যানেজ করছেন। সেখানে গিয়ে তো আর মোবাইলে পৃথিবীর কাজগুলোর দিকনির্দেশনা দেয়া যাবে না। তাহলে সব কাজ এখান থেকেই গুছিয়ে যেতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো তেমনটা কী হচ্ছে?
হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদিস – রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, আমাদের তিন ধরনের বন্ধু আছ। এক ধরনের বন্ধু আছে কবরে যাওয়ার আগ র্পযন্ত সে সাথে থাকবে- এরা হলো মানুষ বন্ধু। আরেক ধরনের বন্ধু আছে-এরা হলো সম্পদ। এর মধ্য থেকে যতটুকু দান করা হবে সেটুকু তোমার অংশ। আর যা তুমি দান করো নি তা তোমার উত্তরাধিকারীর অংশ। আরেক ধরনের বন্ধু হলো র্কম। তুমি যেখানে যাও সে তোমার সাথে থাকবে। কবরেও যদি যাও সে তোমার সাথে সেখানে যাবে। আর সেখান থেকে বেরিয়ে তুমি যেখানে যাও সে তোমার সাথে যাবে। মানুষ অবাক হয়ে বলবে আল্লাহর শপথ! আমি তিন বন্ধুর মধ্যে তোমাকেই সবচেয়ে হীন ও অতি সাধারণ মনে করতাম (তারগীব)।সেটাই সৎকর্ম।
স্রষ্টার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের ও অন্যের কল্যাণে করা প্রতিটি কাজই সৎর্কম বা সাদাকা। প্রতিটি কল্যাণকর চিন্তা, কথা, আচরণ ও কাজ সৎর্কম। একটি ভালো কাজের ইচ্ছা মনে মনে করলাম, এটা সৎর্কম হয়ে গলে। এরজন্যে মহান আল্লাহ একটি পুণ্য দিয়ে দিবেন। আর কাজটা করলে দুটো পুণ্য। সৎর্কম কতরকম হতে পারে তার উদাহরণ আমরা পাই নবীজী (স)-এর সমগ্র জীবন থেকে। সহীহ হাদীস অনুসারে মা-বাবার আন্তরিক খেদমত করা, পরিবারের ভরণপোষণ করা, সন্তানের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাহায্য করা, এতিম-মিসকিন ও অসহায়দের লালন করা, রোগীর সেবা ও তার জন্যে দোয়া করা সৎর্কম। মানুষকে অবিদ্যা থেকে মুক্ত করা, জ্ঞান বিতরণ করা, অত্যাচারিতকে সাহায্য করা, প্রাকৃতিক বির্পযয়ে ত্রাণ কাজ, প্রকাশ্যে বা গোপনে র্অথ দান, পথ থেকে পথিকের জন্যে ক্ষতিকর বস্তু অপসারণ, পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, গাছ লাগানো, অধীনস্থদের সাথে মানবিক আচরণ করা, বিপদে সবর করা, ভালো কাজে উৎসাহিত করা, মন্দকাজে বাধা দেয় ইত্যাদি সবই সৎর্কম।
সৎকর্ম একবার দু’বার করার বিষয় নয়। জীবনের প্রতিটি কাজই যেন হয় সৎকর্ম। যেখানে হাসিমুখে কথা বলা, সৎপরামর্শ দেয়া, স্ত্রীর সাথে সুন্দর সময় কাটানো, কারো জন্যে হৃদয় থেকে দোয়া করা সৎকর্ম, সেখানে সৎকর্মের বাহিরে থাকাটাও অনেক কষ্টের, অনেক সাধনার ব্যাপার। তাই সদা-সর্বদা লেগে থাকতে হবে সৎকর্মে।পবত্রি ধম্মপদে বলা হয়েছে, ‘সৎর্কমে সদা তৎপর থাকো, পাপ থেকে মনকে নিবৃত করো। ভালো কাজে র্দীঘসূত্রিতা বা আলস্যের প্রশ্রয় দিলে মন পাপে লিপ্ত হবে।’ র্অথাৎ সবসময়ই ভালো কাজে থাকতে হবে। নয়তো আলস্য ও র্দীঘসূত্রিতা এসে কাজ করার সুযোগ নষ্ট করে দিবে।
দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীন বলতেন, যে পথ দিয়ে এখন যাচ্ছো, সে পথ দিয়ে ফিরতে না-ও পারো। তাই যার জন্যে যতটুকু করতে পারো, করে যাও। কারণ কোন কাজটার মধ্য দিয়ে যে আমার মুক্তি তা কি আমি বলতে পারি নিশ্চিত করে? তাই যত ধরনের সৎকাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে আমরা যেন হই। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি একটি কলার খোসা দেখলাম, সরিয়ে দেই। না হলে অন্য কেউ পিছলে পড়ে মারাত্মক চোট পেতে পারেন।শরীর-স্বাস্থ্য ভালো আছে, রক্ত দান করি। কারণ যে অসুস্থ লোকটির রক্তের প্রয়োজন তার জন্যে রক্তের বিকল্প আর কিছুই নেই। তাই সবসময় সৎকর্মের সন্ধানে থাকতে হবে যে, কোন ফাঁকে একটা সৎর্কম করে ফেলা যায়।
আসলে নিজেদের পরকালীন মুক্তির জন্যেই সৎকর্ম করতে হবে। সূরা বাকারার ২ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, ‘(হে বিশ্বাসীগণ!) তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো। পরকালীন মুক্তির জন্যে তোমরা যতটুকু সৎকর্ম করবে, তার সবটাই আল্লাহর কাছে জমা থাকবে। আল্লাহ তোমাদের সব কাজেরই দ্রষ্টা।
সৎকর্মশীলদের পরকালে কোন ভয় থাকবে না, কোন দুঃখ থাকবে না। তারা মহাপুরষ্কারে পুরস্কৃত হবেনই। এ বিষয়ে সূরা বাকারা’র ১১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আসল সত্য হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে যারাই আল্লাহতে পুরোপুরি সমর্পিত হবে এবং সৎকর্ম করবে, প্রতিপালক অবশ্যই তাদের যথাযথ পুরষ্কার দেবেন। তাদের কোন ভয় বা দুঃখ থাকবে না।’
কারো চাপে পড়ে, জোড় বজরদস্তি করে সৎকর্ম হয় না। সৎকর্ম করতে হয় নিজের মন থেকে এবং একমাত্র স্রষ্টার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। তবেই তা স্রষ্টার পক্ষথেকে পুরস্কার ও অতিরিক্ত কল্যাণ নিশ্চিত করে। সূরা বাকারার ১৫৮ নম্বর আয়াতের শেষের দিকে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘—-আর যে ব্যক্তি স্বতঃস্ফুর্তভাবে সৎকর্ম করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তার পুরষ্কার দাতা, সেই সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত।’ একইভাবে সূরা বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতের শেষের দিকে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘—- আর যদি কেউ আনন্দচিত্তে বেশি সৎকর্ম করে, তবে তা তার জন্যে অতিরিক্ত কল্যাণ বয়ে আনবে।—-’
সূরা আনআমের ১৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কেউ কোন সৎকর্ম করলে, সে তার ১০ গুণ পুরষ্কার পাবে।’ তাই সৎকর্ম অল্প হলেও তা করতে হবে নিয়মিত। মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়িয়ে অনেকে বলবে আমাকে সুযোগ দেয়া হউক, সময় দেয়া হউক আমি বেশি বেশি সৎকর্ম করবো। কিন্তু সেদিন ভিসার মেয়াদ শেষ।সেদিন আর কিছুই করার থাকবে না। প্রস্তুতি থাকুক আর না থুাকুক, চলে যেতে হবে স্রষ্টার ডাকে। পালানোর কোন যায়গা নেই, লুকানোর কোন সুযোগ নেই। তাই প্রস্তুতি নিতে সময় থাকতেই। সময় শেষ হয়ে যাবে যেকোন সময়। সময় থাকতে সৎকর্মে আত্মনিয়োগ করাই প্রজ্ঞাবানের কাজ, আর এটাই এনে দিবে চুড়ান্ত মহাসাফল্য। কেউ যদি বিশ্বাসী হয়ে সৎকর্ম করে তাদের জন্যে রয়েছে অফুরন্ত কল্যাণ। এ বিষয়ে কোরআনের আলোকে ‘বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলরাই হবে চুড়ান্ত সফল শিরোনামে আমার একটি লেখা এই সাইটে রয়েছে।