দুশ্চিন্তা ও আলসেমি কী? দুশ্চিন্তা ও আলসেমি পরিত্যাগে করণীয় কী?

দুশ্চিন্তা ও আলসেমি কী? দুশ্চিন্তা ও আলসেমি পরিত্যাগে করণীয় কী?

শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্যে যেমন প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক খাদ্যাভাস, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন, নিয়মিত ব্যায়াম-খেলাধূলা তেমন প্রয়োজন সৎ চিন্তা ও সৎ কর্ম। কেউ যদি সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকে, কর্ম বিমুখ অলম জীবন যাপন করে কিংবা কাজ করলেও অপকর্মে লিপ্ত থাকে, সে না থাকে শারীরিকভাবে ভালো, না থাকে মানষিক দিক থেকে সুস্থ। শারিরীক ও মানসিক সুস্থতার জন্যে প্রয়োজনীয় অন্যসব কিছুর সাথে থাকতে হবে সৎ চিন্তা ও সৎ কর্মের সাথে একাত্মতা।

মানুষের জীবনের স্বার্থকতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে তার কর্মের উপর। আর কর্ম নির্ভর করে অভিপ্রায় বা চিন্তার উপর। তাহলে বলা যায় যে চিন্তার উপর নির্ভর করে একজন মানুষের সামগ্রীক জীবনের স্বার্থকতা বা ব্যর্থতা। জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে হলে প্রতিটি কাজের পূর্বেই ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এটাকেই বলা হয়, ভাবিয়া করিও কাজ। মানুষের যত শক্তি আছে যেমন অর্থনৈতিক শক্তি, পেশী শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, বাক শক্তি সহ সকল শক্তির চেয়ে চিন্তা শক্তি সবচেয়ে বেশী শক্তিমান। ধম্মপদে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা বা অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটে স্বভাব বা প্রকৃতিতে।’
পবিত্র কোরআনের বহু যায়গায় স্রষ্টা মানুষকে তাঁর সৃষ্টি নিয়ে, কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে চিন্তা করতে বলেছেনে, ভাবতে বলেছেন। সূরা ওয়াকিয়া, আয়াতঃ৬২ তে মহান স্রষ্টা বলে, “তোমাদেরকে প্রথমে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তো তোমরা জানো। তাহলে কেন তোমরা স্রষ্টা সম্পর্কে চিন্তা করবে না?” একই সূরার ৬৩ নম্বর আয়াতে স্রষ্টা বলেন, “তোমরা যে জমিনে বীজ বপন করো, সে সম্পর্কে কি কখনো চিন্তা করেছো?” আবার একটু এগিয়ে ৬৮ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, “তোমরা যে পানি পান করো, সে সম্পর্কে কি তোমরা চিন্তা করেছ?”

আসলে বিশ্বাসী মাত্রই চিন্তাশীল। সে তার কর্মপন্থা-কর্মপ্রক্রিয়া-কর্মের ফলাফল নিয়ে চিন্তা করবে। স্রষ্টা কী লক্ষ্যে আমাকে পাঠিয়েছেন, পৃথিবীতে আমার করণীয় কী, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা আবশ্যক। সূরা হাশর এর ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহ সচেতন থেকো। প্রত্যেক মানুষেরই চিন্তা করা উচিত যে, পরকালের জন্য সে আগাম কী পাঠাচ্ছে!”
আইনষ্টাইন বলেছেন, “আমি কখনো আমার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেই নাই। আমি শুধু তাদেরকে পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছি যাতে তারা চিন্তা করতে পারে ও তা থেকে শিখতে পারে।”

অতএব চিন্তা করতে হবে। জীবনকে সাজাতে, জীবনকে রাঙাতে, জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে চিন্তা ভাবনা করতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। মূলত চিন্তাই হলো জীবনের চালিকা শক্তি। কোন এক সকালের একটি চিন্তা একজন মানুষের সমগ্র জীবনটাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে, পরিবারকে, সমাজকে, জাতীকে এমনকি পুরো সভ্যতাকে তার কাছে ঋণী করে দিতে পারে।

চিন্তাই প্রসব করে কাজ। একজন মানুষের জীবন হচ্ছে একটি বাগান, আর চিন্তা হচ্ছে বীজ। সে চাইলে তার বাগানে ফুল-ফলের বীজ বপন করতে পারে, আবার আগাছা জন্মাতে দিতে পারে। আর তাই ইতিবাচক চিন্তা সেই সাথে ইতিবাচক উপলব্ধি ও ইতিবাচক কাজ আবশ্যক। একজন মানুষকে তার চরম শত্রুও এতটা ক্ষতি করতে পারে না, বা পরম বন্ধুও এতটা উপকার করতে পারে না, যতটা ক্ষতি বা উপকার করতে পারে তার নিজের চিন্তার প্রক্রিয়া। তাই সচেতনভাবে ভ্রান্ত চিন্তা, অকল্যাণ চিন্তা ও দুুিশ্চন্তা থেকে বিরত থাকতে হবে। দুশ্চিন্তা অশান্তি ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারে না। যত মানসিক অশান্তি আর শারীরিক অসুস্থতা আছে সবকিছুরই একমাত্র কারণ দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা বা নেতিচিন্তা কখনোই ইতিবাচক জীবন, ইতিবাচক বাস্তবতা উপহার দিতে পারে না।

অধিকাংশ সময় আমরা হয়তো অতীত নিয়ে অনুশোচনায় ভুগী; অথবা ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকি। অথচ দুশ্চিন্তাকে জয় করতে হলে, জীবনকে উপভোগ করতে হলে ও জীবনকে অর্থপূর্ণ করতে হলে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে ও ব্যস্ত থাকতে হবে বর্তমান নিয়ে। দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে, অতীতের শিক্ষা থেকে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়ে, বর্তমানকে কাজে লাগিয়ে আমরা একটি সুন্দর ভবিষৎ রচনা করতে পারি।

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখী হই তার অধিকাংশেরই সমাধান আছে ও সময়ের ব্যবধানে তার সমাধান হয়। অতএব সে বিষযগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তায় না ভুগে সুন্দর সমাধানের পথ-পরিকল্পনা চিন্তা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আবার যে সকল সমস্যার সমাধান নেই সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেই বা লাভ কী? বরং সেটা নিয়ে বিকল্প চিন্তা করাই প্রজ্ঞার কাজ। দুশ্চিন্তা বা নেতিচিন্তাকে জয় করার একমাত্র আশ্রয় হচ্ছে সুচিন্তা অর্থাৎ ইতিবাচক চিন্তা। জীবনে কোন পর্যায়ে বিপর্যয়, সাময়িক পরাজয় আসতেই পারে। কিন্তু নিজেকে বিপর্যস্ত, পরাজিত ভাবনার দুশ্চিন্তাই আমাদেরকে থামিয়ে দেয়। তাছাড়া সাময়িক বিপর্যয়, পরাজয় আমাদের দাবিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে না। আমরা মূলত পরাজিত হই নিজের দুশ্চিন্তার কাছে।

দুশ্চিন্তা আসলে জীবনে কী ঘটেছে তা নিয়ে নয়; জীবনে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে। যার অধিকাংশই আমাদের কারো জীবনে ঘটে না। দুশ্চিন্তা জীবন থেকে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয। এটা শুধু আপনার আনন্দকে নষ্ট করতে পারে আর কিছুই না করার মধ্যে ব্যস্ত রাখতে পারে। অশান্তির প্রাথমিক কারণ হচ্ছে জীবনে ঘটে যাওয়া কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা নয়। বরং জীবনে কখনো যদি কোন অপ্রত্যাশিত-অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে তাহলে কী কষ্ট-কী অসুবিধা-কী সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে ভাবনা অর্থাৎ দুশ্চিন্তা। যেমন, যদি অসুস্থ হয়ে যাই, যদি চাকরী চলে যায়, যদি পরীক্ষায় খারাপ করি, যদি ব্যবসায় লোকসান হয়, এমনকি যদি মারা যাই ইত্যাদি। অথচ এগুলোর একটাও আপনার জীবনে ঘটেনি। কিন্তু এর কোন একটি জীবনে ঘটলে কী কী সমস্যা-অসুবিধা হতে পারে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন আর না ঘটা ঘটনাগুলো জীবনে ঘটলে কী কষ্টগুলো হতে পারতো বা হতে পারে সে কষ্টগুলো কল্পনায় আপনি ভোগ করছেন।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, It is not the load that breaks you down, rather, it is the way you carry it. তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, পারিপার্শিক অবস্থার উপর নয়; আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপরই নির্ভর করছে আপনার সুস্থতা, প্রশান্তি, সাফল্য। আবার আমরা এভাবেও বলতে পারি যে, কোন ঘটনা বা অবস্থার উপর আমাদের প্রতিক্রিয়া বা তা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াই হলো আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। আমরা মনে করি এটা এটা এটা আমার দুশ্চিন্তার কারন। কিন্তুু বাস্তবতা হলো এটা এটা এটা নিয়ে আমার চিন্তার প্রক্রিয়াটাই হলো দুশ্চিন্তার কারণ।

মূল কথা হলো, নেতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গি আর চাওয়া – পাওয়া – অতৃপ্তি ; চাওয়া – না পাওয়া – হতাশা এই বৃত্ত হচ্ছে আমাদের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ। সকল দুশ্চিন্তার কারণই হলো এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সমস্যার সমাধান নয়; চিন্তার সমাধান করতে পারলে, অর্থ্যাৎ দুশ্চিন্তা না করে সুচিন্তা করতে পারলে সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যায়।

আমাদের শরীর ও মনে সুচিন্তা ও দুশ্চিন্তার রয়েছে বহুমুখী ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। সুচিন্তা আমাদের প্রফুল্ল রাখে, প্রশান্তি দেয়, সৃজনশীল করে এবং সমৃদ্ধি ও সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অপরদিকে দুশ্চিন্তা শুধু আমাদের প্রশান্তিকে নষ্ট করে তা নয়, আমাদের সৃজনশীলতা, কর্মক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, মেধাকে নষ্ট করে।

আমাদের অধিকাংশ শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার অন্যতম কারণ হলো এই দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা থেকেই শরীরে বাসা বাঁধে গ্যাসট্রিক, আলসার, ব্লাড প্রেসার, হৃদরোগ সহ নানা জটিল রোগ। Tension creates toxin in our body. And toxin causes all diseases. অথচ আমরা তা চাই না। আমরা চাই প্রশান্তি, সাফল্য, সমৃদ্ধি। আর তাই আমরা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে সুচিন্তায় অভ্যস্ত হবো। চিন্তার ফল হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানীরাই চিন্তা করে। পবিত্র কোরআনে সূরা আলে-ইমরান এর ১৯০ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিনরাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। অর্থ্যাৎ, জ্ঞানীরা এগুলো দিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। মহান প্রভু আমাদেরকে চিন্তাশীল হিসেবে কবুল করুন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এবার আমরা আলোকপাত করবো আজকের আলোচনার দ্বিতীয় অংশ নিয়ে। যে আমরা কর্মঠ হবো, কাজ করবো, কাজ প্রত্যাশা করবো। কাজ নিয়ে আলসেমি করবো না। কাজ ফেলে রাখবো না। এখনকার কাজটি এখনই করবো। পরে করবো বলে কোন কাজই ফেলে রাখা উচিত না। অধিকাংশ সময়ই Later becomes never আর তাই যখনকার কাজ তখন।
আসলে কাজ করতে পারার সামর্থ্য -স্রষ্টার একটি বিশেষ রহমত, বিশেষ নেয়ামত। একইভাবে কাজ থাকাও স্রষ্টার রহমত। আমাদের চারপাশে এমন অনেকেই আছে যাদের কাজ করার শক্তি সামর্থ্য নেই। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। আবার অনেকে আছে যাদের কাজ করার সামর্থ্য আছে কিন্তু করার মতো হাতে কোন কাজ নেই। বেকার, অলস সময় পার করছে।

আমাদের যাদের কাজ করার শক্তি সামর্থ্য আছে এবং হাতে কাজ আছে, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। আর সেই সৌভাগ্যের জন্য স্রষ্টার শোকরিয়া আদায় করি। শোকরিয়ার সবচেয়ে ভালো প্রকাশ হলো কাজ কে ভালোবাসা, কাজ প্রত্যাশা করা, আনন্দ ও আন্তরিকতার সাথে সময়ের কাজ সময়ে করা। আসলে Work without love is slavery. যে কাজ ভালোবেসে করা হয় না, সেটা কাজের দাসত্ব করা ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজটি করতে হবে তাই করছি এমনটি নয়, বরং কাজটি ভালোবেসে করছি।

কাজকে প্রত্যাশা করতে হবে। কোনভাবেই কাজকে ভয় পাওয়া যাবে না, কাজকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আপনি আজ কাজকে ভয় পাবেন, কাজকে এড়িয়ে যাবেন, কাজ নিয়ে আলসেমি করবেন কালকে কাজ আপনাকে ভয় পাবে, আপনাকে এড়িয়ে যাবে। অসুস্থ হয়ে চিৎ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবেন। কাজ বলবে, বাপরে বাপ ওর কাছে যাওয়া যাবে না। ও কাজকে ভয় পায়, কাজ নিয়ে আলসেমি করে।

একটু চিন্তা করলে দেখবেন যে কাজ করার চেয়ে কাজ না করা বেশী কষ্টের, বেশী ক্লান্তিকর। আপনি কোন কাজ করছেন না, আলস্যে সময় অতিবাহিত করছেন। আপনার সময় কাটবে না। মনে হবে যেন দিন শেষ হচ্ছে না, রাত শেষ হচ্ছে না। অলস ব্যাক্তিদের কেউ পছন্দ করে না। তাদের সাথে কেউ সখ্যতা গড়েনা। অধিকাংশ অসৎ চিন্তাই অলস ব্যক্তির মস্তিস্ক প্রসূত। এজন্যেই বলা হয় অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। তাই সবসময় কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। শয়তান এসে যখন দেখবে আপনি ব্যস্ত আছেন, তখন সে আপনার কাছ থেকে চলে যাবে। সে খুজবে অলস লোক। কারণ অলস ব্যক্তিকে দিয়েই শয়তান তার কাজটি সুন্দর করে করিয়ে নিতে পারবে। অলসরাই হচ্ছে অপকর্মের মূল হোতা, শয়তানের হাতিয়ার। ঋগবেদে বলা হয়েছে, ‘অলস মস্তিস্ক কুচিন্তার সহজ শিকার।

পরিশ্রম এবং আলস্য আসলে একটি দ্বিমুখী রাস্তা। আপনি যে পরিশ্রম দিবেন, তার সুমিষ্ট ফলাফল আপনি পাবেন। আবার আপনি আলস্যে দিনাতিপাত করবেন, সেরুপ ব্যর্থতা, অন্যের উপর নির্ভরশীলতা, অমর্যাদা আপনার দিকে ফেরত আসবে। আমরা জানি যে আলস্য দোষের আকড়। একজন মানুষের জীবনে যত ব্যর্থতা থাকতে পারে তার অধিকাংশই আসে আলস্য থেকে। সমস্যার উৎপত্তিই হয় এই আলস্য থেকে। সূরা রাদ এর ১১ নম্বর আয়াতে স্রষ্টা বলেন, “নিজের ভেতর থেকে না বদলালে (অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে) আল্লাহ কোন জাতির (বা মানুষের) অবস্থা বদলান না।” তাহলে আমাদের দারিদ্রাবস্থা, দৈন্যাবস্থা বদলাতে হলে প্রথমে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। যে, আর নয় আলস্য। কর্মমুখী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে।

একজন অলস মানুষ জীবন্ত থেকেও মৃত প্রায়। আবার আলস্যকে একজন জীবন্ত মানুষকে কবর দেয়ার সমানও বলতে পারেন। আলস্য একজন মানুষের সকল উদ্যোগ, সকল স্বপ্নকে স্থবির করে দেয়। যতনা মানুষ বেকারত্বের কারণে অর্থকষ্টে, ক্ষুধার কষ্টে থাকে তার চেয়ে বেশী মানুষ আলস্যের কারণে অর্থকষ্টে, ক্ষুধার কষ্টে থাকে।
লোহার উপর মরিচা যেমন লোহার গুণাবলী, কার্যক্ষমতাকে দিনে দিনে নিঃশেষ করে ফেলে, আলস্য তেমনী একজন মানুষের আত্মমর্যাদা, কর্মক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলে। পরিনামে সে হয় ব্যর্থ, দূঃসহ জীবনই হয় তার সঙ্গী। একজন কর্মঠ মানুষ কাজের ফলাফল দেখে, সাফল্য দেখে; একজন অলস মানুষ শুধু স্বপ্ন দেখে।

আসলে কাজের জন্যই জীবন। মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মাধ্যমেই। আজকে যাদেরকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করি তারা কেউ জীবনে অলস ছিলেন না। তাঁরা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কাজের মাধ্যমেই তাঁরা অমর হয়েছেন। তাঁরা স্বরণীয়-বরণীয় হয়েছেন। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম ছিলেন কর্মী পুরুষ। তিনি কাজকে পছন্দ করতেন। জীবনের শেষ মুহুর্তেও কাজ করতে করতেই স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছেন। তিনি কাজকে এতটাই ভালোবাসতেন যে, তিনি বলেছিলেন, আমার মৃত্যুতে তোমরা শোক পালনে একদিন কাজ বন্ধ না রেখে বরং পারলে একদিন কাজ বেশী করবে।’ অপরদিকে যারা কাজকে এড়িয়ে চলেছেন, আলস্যকে পছন্দ করেছেন, আলস্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কালের স্রোতে হারিয়ে গেছেন। তাদের কথা কেউ স্বরণ করে না। আবার কাউকে কাউকে আলস্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সম্মান করা হয় না, শ্রদ্ধা করা হয় না।

তাই আলস্য নয়, আমাদেরকে কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। মূর্খরাই আলস্যে নিপতিত হয়। কাজের জন্য একটাই জীবন। এই পৃথিবীতে আসার পূর্বেও আমাদের কোন কাজ করতে হয়নি, আবার পরকালীন অনন্ত কালের জীবনেও কোন কাজ থাকবে না। কাজের জন্যই পৃথিবী। আর এ সকল কাজের হিসাবও স্রষ্টা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রাখেন এবং এর হিসেব নিবেন। সূরা গাশিয়াহ এর ২৫-২৬ আয়াতে স্রষ্টা বলেন, “অবশ্যই ওদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে এবং সকল কাজের হিসাব দিতে হবে আমারই কাছে।” এই পৃথিবীর কাজের উপরই নির্ভর করবে পরকালে আমরা অনন্ত প্রশান্তিতে থাকবো, না চির অশান্তির আগুনে নিক্ষেপিত হবো। জীবনকে স্বার্থক করতে হলে, চির প্রশান্তিতে অবগাহন করতে হলে কাজ করতে হবে। উত্তম কাজ করতে হবে। যে কাজে নিজের কল্যাণের পাশাপাশি অন্যের কল্যাণও নিশ্চিত হয় এমন কাজ করতে হবে। সূরা আর রাহমান এর ৬০ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, “উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরষ্কার ছাড়া আর কী হতে পারে?”
ধম্মপদে বলা হয়েছে, ‘আলস্যকে প্রশ্রয় দিও না। ধর্মকে অনুসরণ করো। ইহলোক ও পরলোক দুই লোকেই সুখে থাকবে।’
আলোচনার এই পর্যায়ে এসে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে চাই যে আমরা দুশ্চিন্তা না করে সুচিন্তা করবো, আলস্যে সময় নষ্ট না করে সৎকাজে ব্যস্ত থাকবো। তাহলে দুনিয়াতে যেমন আমরা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, আত্মিকভাবে ভালো থাকবো, পরকালেও থাকবো অনন্ত আনন্দলোকে।

2 thoughts on “দুশ্চিন্তা ও আলসেমি কী? দুশ্চিন্তা ও আলসেমি পরিত্যাগে করণীয় কী?

Leave a Reply

Your email address will not be published.