ক্ষোভ থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী?

ক্ষোভ থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী?

রাগ-ক্ষোভ সম্পর্কে পূর্বের দু’টি আলোচনা থেকে আমরা এটা অনুধাবন করতে পারছি যে আমাদের এই ছোট জীবনের যে অংশটুকু রাগ-ক্ষোভে কাটাই সে অংশটুকু মূলত জীবনের অচপয়। সুস্বাস্থ, সাফল্য ও প্রশান্তির পথে বাধা হচ্ছে রাগ ও ক্ষোভ। দুনিয়ার জীবন অর্থপূর্ণ ও আনন্দময় করতে হলে এবং পরকালে অনন্তসুখে অবগাহন করতে চা্ইলে  রাগ-ক্ষোভের উর্দ্ধে উঠতে হবে। আর এই জন্য আমরা কিছু আচরণ অভ্যাস অনুসরণ করতে পারি –

রাগ-ক্ষোভের বিপরীত হচ্ছে ভালবাসা। মানুষকে ভালবাসতে হবে জাতী- – ধর্ম – বর্ণ – গোত্র – গরীব – ধনী নির্বিশেষে। আর ভালবাসতে পারলেই অন্যের ভুলকে সহজে ক্ষমা করা যায়। তাই আমরা অন্যের ভুল ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখব এবং অন্যের কাছ থেকে বিনিময়ে  কিছু প্রত্যাশা করব না বরং নিঃস্বার্থভাবে অন্যকে দেয়ার মধ্যেই নিজের সুখ খোঁজব।

যখন কারো সাথে রাগ বা ক্ষোভের কোন কারণ ঘটে তখন অতীতে সে এমন কী করেছিল যার জন্য তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এমন দশটি ঘটনা আমি স্মরণ করবো এবং সেগুলো কাগজে লিখব। তাতে তার প্রতি আমার রাগ-ক্ষোভ মুছে গিয়ে কৃতজ্ঞতায় হৃদয় ভরে উঠবে। অন্যের ভুলের জন্য রাগ বা ক্ষোভ পোষণ না করে স্রষ্টার কাছে তার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করব।

রাগ – ক্ষোভ থেকে মুক্ত থাকার সর্বোচ্চ উপায় হচ্ছে ক্ষমা করা। অনের যে ভুলের জন্য আমরা তার সাথে রাগ করি বা ক্ষোভ পোষণ করি; সে ভুলকে ক্ষমা করে দিতে পারলেই তার সাথে রাগ বা ক্ষোভ থাকে না।

ক্ষমার বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আরাফ এর ১৯৯ থেকে ২০০ আয়াতে নবী (সঃ) কে বলছেন, “ হে নবী! (মানবীয় প্রকৃতির দিকে খেয়াল রেখে) তুমি ক্ষমাশীল হও। সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করো এবং আহাম্মকদের থেকে দূরে থাকো। আর শয়তানের প্ররোচনায় যদি তুমি উত্তেজিত (রাগান্বিত) হও, তবে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন।”

আমরা জানি যে মহান আল্লাহর কাছে রয়েছে উত্তম, উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী কল্যান  এবং সেগুলো যারা লাভ করবে তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে সূরা আশ্ – শুরা এর ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যারা বড় গুনাহ ও নির্লজ্জ কাজ হতে বিরত থাকে। আর ক্রোধের সঞ্চার হলে ক্ষমা করে দেয়।”

একই সূরার ৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা বলেন “অবশ্য যে ব্যাক্তি ধৈর্য ধারন করে এবং ক্ষমা করে, তার সে কাজ নিঃসন্দেহে বড় উচ্চমানের সাহসিকতাপূর্ণ কাজের অর্ন্তভুক্ত।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু দুনিয়ায় শান্তি ও সুস্থতার জন্যই নয় বরং স্রষ্টার কাছে যে চিরস্থায়ী সুখ রয়েছে অর্থাৎ অনন্ত সুখের জান্নাতের অধিবাসী হতে হলেও রাগ ক্ষোভ সংবরণ করে ক্ষমাশীল হতে হবে। আল্লাহ নিজে ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা স্রষ্টার কাছে একটি অতি উচ্চমানের কাজ।

শোকর গুজার থাকব। কারো কাছ থেকে হয়তো প্রাপ্য কিছু পাইনি; তাতে কী? স্রষ্টাতো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। অতএব কারো প্রতি রাগ বা ক্ষোভ পোষণ করা অর্থহীন। আমার জন্য আমার স্রষ্টাই যথেষ্ট-এ ধারণাই অন্তরের গভীরে পোষণ করবো।

রাগের মাধ্যমে আমরা নিজেকে সঠিক ও অন্যকে ভুল প্রমানের চেষ্টা করি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমি কী নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে চাই নাকি নিজেকে সুখী করতে চাই? নিজের সকল সুখ ও প্রশান্তির বিনিময়ে কোন একটি বিষয়ে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করা কতটা অর্থপূর্ণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত সেটাই বিচার্য বিষয়। 

অধিকাংশ সময়ে আমাদের রাগ – ক্ষোভ হয়ে থাকে আমাদের স্রী, সন্তান, পরিবার -পরিজনদের সাথে। আর এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলআমীন বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ!কখনো কখনো তোমাদের জীবনসাথী এবং সন্তান তোমাদের শত্রু হয়ে দাঁড়াতে পারে। অতএব সাবধান থেকো! (তবে অনুশোচনা করলে) তোমরা যদি ওদের প্রতি সহনশীল হওএবং ওদের ক্ষমা করো, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরমদয়ালু।।” – সূরা তাগাবুন – আয়াত  ১৪। এভাবে পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় সহনশীল হয়ে রাগ-ক্ষোভ থেকে মুক্ত থাকার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

ক্ষমা সম্পর্কে মহানবী (সঃ) বলেন, “যে স্রষ্টার সন্তুষ্টির উদ্দ্যেশে কাউকে ক্ষমা করে দেয়; বিচার দিবসে মহান আল্লাহ তাকে সম্মানিত করবেন।

ক্ষমা মূলত অন্যের অন্যায় ব্যবহারকে ক্ষমা করা নয়; অন্যের অন্যায় ব্যবহার দ্বারা নিজের হৃদয়কে ধ্বংস থেকে প্রতিরক্ষা। অর্থাৎ অন্যের অন্যায় আচরণ সত্বেও নিজে রাগ – ক্ষোভ থেকে মুক্ত থাকা।

ক্ষমা করা সব সময় সহজ নয়। কখনো কখনো অন্যের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টের চেয়েও ক্ষমা করা বেশী কষ্টকর। তাপরও ক্ষমা করতে হয়; কেননা ক্ষমা করা ছাড়া কোন প্রশান্তি নেই। আসলে দূর্বলরা ক্ষমা করতে পারে না; ক্ষমা হচ্ছে শক্তিমানদের গুণ। ক্ষমা ছাড়া ভালবাসা হয়না এবং ভালবাসা ছাড়া ক্ষমা করা যায় না।

অন্যকে এত দ্রুত অন্যকে ক্ষমা করবো; যত দ্রুত স্রষ্টার কাছ থেকে আমরা ক্ষমা প্রত্যাশা করি।  অন্যদের ক্ষমা করার মাধ্যমে আসলে একজন অন্যের শক্তির নিয়ন্ত্রক হয়ে যায়।

অন্যের ভুলের জন্য যেমন তাদের ক্ষমা করতে হবে, তেমনি নিজের ভুলের জন্যও নিজেকে ক্ষমা করতে হবে। কারণ অনেক সময় নিজের ভুলের জন্যও নিজের উপর রাগ – ক্ষোভ হয়, নিজেকে ক্ষমা করা যায়না, সবসময় অনুশোচনার দহনে জ্বলতে থাকি। ক্ষমাকরাকে নিজের চারিত্রকি বৈশিষ্ট্যের অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।

ক্ষমা করা সম্পর্কে ভগবত গীতায় বলা হয়েছে ‘তুমি যদি বিরত্ব দেখতে চাও তবে তাদের দেখ যারা ক্ষমা করে।’

ক্ষমা সর্ম্পকে মহানবী (সঃ) বলেন; “সে প্রকৃত বীর নয় যে যুদ্ধ জয় করে; সেই প্রকৃত বীর যে তার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”

তুমি যদি তোমার প্রতি অন্যায় – অবিচারের জন্য অন্যকে ক্ষমা কর; তোমার স্বর্গীয় পিতা তোমাকে ক্ষমা করবে – ম্যাথু  ৬ঃ১৪

জনৈক সাহাবী রাসুল (সঃ) কে জিজ্ঞেস করেন যে কতবার ক্ষমা করবেন। জবাবে রাসূল (সঃ) বলেন, “ততবার ক্ষমা কর যতবার তুমি স্রষ্টার কাছ থেকে নিজের জন্য ক্ষমা প্রত্যাশা কর।” সেই ব্যাক্তি আবারও প্রশ্ন করে দিনে কতবার ক্ষমা করবেন। জবাবে রাসূল (সঃ) বলেন, “দিনে কমপক্ষ্যে ১০০ বার ক্ষমা কর।”

তায়েফের ময়দানে কাফেররা যখন নবী (সঃ) কে প্রস্তরাঘাতে রক্তাত করেন, তখনও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (স) তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ও তাদের জন্য স্রষ্টার কাছে ব্যাকুল কন্ঠে প্রার্থনা করেছেন, “এদের জ্ঞান দাও প্রভু; এদের ক্ষমা কর তুমি।” আমরা কোনভাবেই অতীতকে পরিবর্তন করতে পারবো না, কিন্তু ক্ষমা করার মাধ্যমে আমরা একটি সুখকর ভবিষৎ নিশ্চিত করতে পারি । অপরদিকে যে ক্ষমা করতে পারে না; সে রাগ – ক্ষোভের নেতিবাচক বৃত্তে  নিরন্তর ঘুরতে থাকে। ক্ষমা মূলত অন্যের মঙ্গলের জন্য নয়; নিজের মঙ্গলের জন্য, নিজে ভাল থাকার জন্যই অন্যকে ক্ষমা করা। ভুল করা যেমন মানবীয় দূর্বলতা; তেমনি ক্ষমা করা একটি স্বর্গীয় গুণ। যে ক্ষমা করতে পারে না সে মূলত এমন একটি সেতু ধ্বংস করে যে সেতু দিয়ে তাকে অবশ্যই একদিন পার হতে হবে। অতএব দুনিয়া ও পরকালীন মঙ্গলের জন্যই মানুষকে ক্ষমা ও ভালবাসার মাধ্যমে রাগ – ক্ষোভ থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত থাকব। কারণ আমরা চাই মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর নিজের ক্রোধকে দমন ও অন্যকে ক্ষমা করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। এ সম্পর্কে আল্লাহ নিজে বলেন, নিশ্চয়ই যারা (এক) সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে, (দু্ই) রাগ নিয়ন্ত্রণন করে, (তিন) মানুষকে ক্ষমা করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন” – (সূরা আলে – ইমরানঃ আয়াত ১৩৪)। আল্লাহ তায়ালা এখানে দানশীল, রাগনিয়ন্ত্রণকারী ও ক্ষমাশীল ব্যাক্তিকে ভালবাসার নিশ্ছয়তা প্রদান করেছেন। আর আমরাতো শুধু প্রভূর ভালোবাসাই চাই।তাই এই গুণগুলো অর্জন করার মাধ্যমে আমারা নিশ্চিতভাবে  স্রষ্টার ভালবাসা অর্জন করতে চাই। মহান রাব্বুল আলআমীন আমাদের কবুল করুন।

2 thoughts on “ক্ষোভ থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী?

  1. লিখাটা রাগ-ক্ষোভ থেকে মুক্ত হতে ও মুক্ত থাকতে সহায়ক হবে অাশা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.