আধূনিক মানুষের সুস্থ জীবন যাপনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দুুশ্চিন্তা। আমরা যখন দুশ্চিন্তা করি তখন আমাদের রক্তচাপ, হদস্পন্দন, মাংসপেশীর চাপ বা পেশীর চাপ বেড়ে যায়। হৃদরোগ, ক্যান্সার, ফুসফুসের জটিলতা, লিভার সিরোসিস সহ আরো নানা জটিল রোগের মূলে এই টেনশন।
অধিকাংশ সময় আমরা হয়তো অতীত এর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে অনুশোচনায় ভুগী নয়তো ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগী। আর এর ফলে আমাদের বর্তমানের প্রশান্তি নষ্ট হয়।
সময়ের সাথে সাথে প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে নতুন নতুন দুশ্চিন্তার অনুষঙ্গ যোগ হচ্ছে। দুশ্চিন্তার কারণ এখন বহুমাত্রিক। যেটাকে আমরা বলি যুগযন্ত্রণা।
টেনশন বা দুশ্চিন্তা আসলে জীবনে কী ঘটেছে তা নিয়ে নয়; জীবনে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে। যেমন- যদি চাকরী চলে যায়, যদি ব্যবসায় লস হয়, যদি অসুস্থ হয়ে যাই ইত্যাদি। অথচ এগুলোর অধিকাংশই আমাদের কারো জীবনে ঘটে না। জীবনে না ঘটা ঘটনাগুলো যদি ভবিষ্যতে কখনো ঘটে তাহলে কী কষ্ট, কী সমস্যা, কী ভোগান্তি হতে পারে সেগুলোকে আমরা কল্পনায় ভুগতে থাকি আর দুশ্চিন্তা করতে থাকি।
যেমন কেউ কেউ দুশ্চিন্তা করে এ নিয়ে যে, সন্তান যদি ভালো রেজাল্ট না করে, ভালো চাকরী না পায়, যদি সন্তান বড় হয়ে আমাদের দায়িত্ব না নেয় তাহলে কী হবে? অথবা, ছোট ছোট সন্তানদের রেখে যদি আমি মারা যাই তাহলে ওদের কী হবে? আমার স্বামী বা স্ত্রী যদি মারা যায় বা ছেড়ে চলে যায় তাহলে ভবিষৎ কী হবে? শিক্ষার্থীদের টেনশন যদি পরীক্ষায় কমন না পাই, জিপিএ-৫ না পাই, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে, অমুক বিষয়ে চান্স না পাই ইত্যাদি।
কেউ কেউ চিন্তা করে যে, আমারতো কোন জমানো টাকা নেই, বিক্রি করার মতো কোন সম্পদ নেই। এমতাবস্থায় যদি আমার নিজের বা আমার পরিবারের কারো জটিল অসুখ হয় তাহলে আমি চিকিৎসার টাকা পাবো কোথায়? বাচ্চাদের যদি ভালো প্রতিষ্ঠানে লেখা-পড়া না করাতে পারি তাহলে কী হবে? পত্রিকায় দেখি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে প্রতিবেশী এক পরিবারের সবাই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। আমরাওতো গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না করি। আমাদের সিলিন্ডারও যদি বিস্ফোরিত হয়? এরকম নানা ধরনের টেনশনে আমরা জর্জরিত।
আবার ধরুন, আপনি সকালে অফিসে যাওয়ার সময় দেখলেন যে একটি প্রাইভেট কার একটি রিক্সাকে ধাক্কা দিল। রিক্সাটি উল্টে পড়ে যেতে যেতে কোনরকমে বেঁচে গেল। রিক্সায় এক মায়ের কোলে ছিল তার নবজাতক শিশু। এখন আপনি সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত শুধু একথাই ভেবে যাচ্ছেন যে, আহারে! যদি রিক্সাটি উল্টে যেতো তাহলে কী হতে পারতো? বা যদি মায়ের কোল থেকে নবজাতক শিশুটি ছিটকে পড়ে যেত তবে সে মায়ের কী হতো? বা যদি গাড়ীর নিচে চাপা পড়ে শিশুটির মা মারা যেতো তাহলে এই ছোট শিশুটির কী হতো? এরকম হাজারো ভাবনা আপনাকে আচ্ছন্ন করছে। আপনি খাওয়া–দাওয়া, ঘুম সব ছেড়ে দিয়ে শুধু সে ঘটনা কতদূর যেতো পারতো তা নিয়ে পড়ে আছেন আর টেনশন করছেন। অথচ আপনার কল্পনার জগতে ঘুরপাক খাওয়া ঘটনাগুলোর একটিও ঘটেনি। আপনি শুধু ভাবছেন যে যদি এমনটি হতো তাহলে কী হতো। আর এভাবেই আমাদের জীবনের অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো ঘটলে কী হতে পারে কল্পনায় তা ভাবি আর টেনশন করি। অথচ এঘটনাগুলো অধিকাংশই আমাদের জীবনে ঘটেনা। ঘটনাগুলো ঘটলে যে কষ্টটা হতো, কল্পনার জগতে সে কষ্টগুলো উপভোগ করতে থাকি। অনেক মজা করে, আয়েশ করে টেনশিন করি। টেনশনের কারণ নিজের না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে ধার করে নিয়ে টেনশন করি।
কিন্তু টেনশনের শুধু মজা নয়, আছে কঠিন সাজাও। দুশ্চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয় ক্ষতিকর টক্সিন। টক্সিন থেকে সৃষ্টি হয় নানা জটিল ধরনের অসুখ বিশুখ। যেমন –
- হার্ট ডিজিজ
- হাইপারটেনশন
- হাই প্লাড প্রেশার
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
- স্ট্রোক
- আইবিএস
- আলসার
- ডায়াবেটিস
- মাসল ও জয়েন্ট পেইন
- মিসক্যারেজ
- মাথাব্যাথা
- এলার্জি সহ আরোও অনেক শারিরীক ও মানসিক জটিলতা।
আবার এমনও দেখা যায় যে আপনি অসুস্থ। বহু ডাক্তার দেখিয়েছেন। বহু পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন। কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। ঔষধের পর ঔষধ খেয়ে যাচ্ছেন। কোন লাভ নেই। অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। আপনি কষ্ট করে যাচ্ছেন, অথচ ডাক্তার বলছেন যে আপনার কিছুই হয়নি। তাহলে সমস্যা কোথায়? এসকল সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে টেনশন। ছোট ছোট রক্তক্ষরণ যেমন মৃত্যুর কারণ হতে পারে, ছোট ছোট টেনশন আপনাকে ভারাক্রান্ত করে তুলতে পারে। হতে পারে মারাত্বাক শারিরীক ও মানসিক ব্যাধি।
তাছাড়া আপনার সৃজনশীলতা, কর্মক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, মেধা, ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক প্রশান্তি সবই নষ্ট করছে এই টেনশন।
আর তাই আমাদের জানতে হবে টেনশনের উৎস ও টেনশন থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে। পরবর্তী আলোচনায় টেনশনের উৎস সমূহ আলোকপাত করবো ইনশাআল্লাহ।