সূরা হুজুরাত এর ১২ নম্বর আয়াতে এক অংশে মহান স্রষ্টা বলেন, “কারো অনুপস্থিতে গীবত অর্থাৎ পরনিন্দা করো না। তোমরা কী মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে চাও? না, তোমরা তো তা ঘৃণা করো (গীবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সমান)।” সূরা বনি ইসরাইল এর ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সোবহানাহুতায়ালা বলেন, “যে বিষয়ে তোমার যথাযথ জ্ঞান নেই, সে বিষয়ে (শুধু শোনা কথায় আন্দাজ–অনুমানের ওপর ভিত্তি করে) কখনো নিজেকে জড়াবে না। (মহাবিচার দিবসে) তোমার কান, চোখ ও মনকে জবাবদিহিতার জন্যে ডাকা হবে।” জিহবা সংযতকারীকে রাসুল (সঃ) জান্নাত এর নিশ্চয়তা দিয়েছেন। অর্থাৎ যিনি জিহবার অপব্যবহার করবেন না, যার শানিত–নোংরা–মিথ্যা কথা থেকে অন্যে নিরাপদ তিনিই প্রকৃত অর্থে জিহবার সংযতকারী। একবার রাসূল (সঃ) হেঁটে যাচ্ছিলেন। দেখতে পেলেন দুইজন সাহাবী বসে অপর একজন সাহাবী (যিনি সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন) সম্পর্কে মন্দ কিছু বলছিলেন। তখন রাসূল (সঃ) চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন যে রাস্তার পাশে পানিতে একটি মরা গাধা ভেসে আছে। তখন তিনি ঐ দুই সাহাবীকে মরা গাধাটা দেখিয়ে সেটাকে নিয়ে আসতে বললেন। তারা সেটাকে নিয়ে আসলে রাসূল (সঃ) তাদেরকে সেই মরা গাধার মাংস ভক্ষণ করতে বললেন। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসূল আল্লাহ, ওটাতো মরে, পঁচে, ফুলে আছে। আর দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এটা কীভাবে খাওয়া সম্ভব? তখন রাসূল (সঃ) বললেন, “তোমরা এতক্ষণ যা করছিলে, সেটা এর চেয়েও জঘন্য। তোমরা মৃত গাধার নয়; বরং আপন মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করছিলে।” একবার রাসূল (সঃ) কয়েকজন সাহাবাকে সাথে নিয়ে একটি কবর স্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখন রাসূল (সঃ) দু’টি কবর এর দিকে ইঙ্গিত করে বলছিলেন যে কবর দু’টিতে আগুন জ্বলছে। তখন সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়া রাসূল আল্লাহ, কেন তাদের এই শাস্তি হচ্ছে?” জবাবে রাসূর (সঃ) বললেন, “তাদের একজন জীবদ্দশায় গীবতে অভ্যস্ত ছিল, আর অপরজন তার জীবদ্দশায় পেশাব করে পানি ব্যবহার করত না।” রাসূল (সঃ) তার মেরাজ এর সময় একটি স্থানে কিছু লোককে দেখতে পেলেন যাদের আঙ্গুলে দস্তার তৈরী বড় বড় লাল রঙ্গের নখ ছিল। তারা সেই নখ দিয়ে তাদের চেহারা ও বুক খামচে খাবলে খুলছিল। তখন রাসূর (সঃ) জীব্রাইল (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, “এরা কারা?” কখন জিব্রাইল (আঃ) বললেন, “এরা জীবদ্দশায় মানুষের মাংস খেত (অর্থ্যাৎ গীবত করতো)।” গীবত শোনা, গীবত করার মতোই সমান অপরাধ। তাই কেউ গীবত করলে, সেটা না শুনে প্রসঙ্গ পরিবতন করে দিতে হবে অথবা সেখান থেকে বিনয়ের সাথে চলে যেতে হবে। যার গীবত করা হয় তার পাপ কমতে থাকে, যিনি গীবত করেন তার পাপের বোঝা বাড়তে থাকে। গীবতকারী ব্যাক্তিত্বহীন, বন্ধুহীন ও আস্থাহীন। সে পরিবার ও সমাজ থেকে শুকনো পাতারমতো ঝড়ে পড়ে।

গীবত এর ভয়াবহতা কীরূপ?
গীবত করা হলো আত্মার রোগ। এটি একটি অন্যতম কবীরা গুনাহ। কারো মধ্যে থাকা কোন দোষের কথা তার অনুপস্থিতে অন্য কারো সাথে বলাই হলো গীবত। কারো কোন বিষয় যা সে অন্যের কাছে প্রকাশ করা পছন্দ করে না, সে বিষয় অন্যের কাছে প্রকাশ করাই গীবত।
আমি তার যে দোষের বা ত্রুটির কথা অন্যের কাছে বলছি সেটি মিথ্যা নয়, সত্যি সত্যিই তার মধ্যে সেই দোষ বা ত্রুটি আছে। তাই গীবত করার পর আমরা নিজেকে সান্তনা দেই এই যুক্তিতে যে আমি তো মিথ্যা কথা বলি নাই। হ্যাঁ, মিথ্যা নয় বলেই এটা গীবত। আর যদি মিথ্যা হতো সেটা হতো অপবাদ।
মহানবী (সঃ) একবার সাহাবাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কী জান গীবত কী?” উত্তরে সাহাবারা বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন।’ রাসূল (সঃ) বললেন, “তোমার ভাই সম্পর্কে অন্যের কাছে এমন কিছু বলা যা প্রকাশ হওয়া সে অপছন্দ করে–এটাই গীবত।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, “তার সম্পর্কে যা বলা হলো তা যদি সত্যি হয় সেটাও কী গীবত?” উত্তরে নবী (সঃ) বললেন, “তার সম্পর্কে যা বললে তা যদি সত্যি হয় তবে তা গীবত; আর যদি তা মিথ্যা হয় তবে তা অপবাদ”- (মুসলিম)। আর অপবাদ দ্বিগুন নোংরা পাপ।
গীবত একটি মারাত্বক কবীরা গুনাহ। যা ইসলামী শরীয়তে হারাম। গীবত সামাজিক বন্ধনকে দূর্বল করে। সমাজে বসবাসরত ব্যাক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে। অন্যকে ছোট করে, হেয় করে নিজেকে বড় করার অপচেষ্টা থেকেই গীবত এর জন্ম।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা এমন অনেক কথাই বলি যা গীবত হয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা তা জানিও না। যেমন আমরা বলি, দেখেছ সে কীভাবে হাঁটে, কিভাবে বাচ্চাদের মত কথা বলে, কত জোড়ে হাসে, অমুক সাহেব ঘুষ খেয়ে কত টাকা কামিয়েছে, ও কত কালো, কত মোটা, লোকটি বেটে , লম্বা, টিকিটিকির মত পাতলা, হাতীর মত মোটা, সে কী উদ্ভট পোষাক পড়েছে, লোকটি কীভাবে চুল কেটেছে ইত্যাদি কথা আমরা সচেতন বা অবচেতনভাবে প্রায়ই বলে থাকি। এ সবই গীবত।
একবার আয়েশা (রা) রাসূল (সঃ) এর কাছে জনৈক মহিলার বর্ণনা দিতে গিয়ে বললেন ”মহিলাটি বেটে” অর্থ্যাৎ খাটো। তখন রাসূল (সঃ) বললেন, “তুমি এমন একটি গীবত করেছ যা সাগরের পানির সাথে মেশানো গেলে সমগ্র সাগরের পানি অপবিত্র হয়ে যেতো।”
“গীবত করা যেনার চেয়েও খারাপ। কেননা কেউ যখন যেনা করে অতঃপতর অনুতপ্ত হয় ও তওবা করে এবং ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের কাজে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করে; তখন স্রষ্টা তাকে ক্ষমা করে দেন। অপরদিকে কারো গীবত করলে, যার গীবত করা হলো তার কাছে ক্ষমা না চাইলে এবং ক্ষমা না পেলে স্রষ্টা তাকে ক্ষমা করবেন না। কারন এটি হলো বান্দার সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ।” – বায়হাকী।
তাই কথা বলার আগে চিন্তা করতে হবে। কারণ কথায় কেউ কষ্ট পেলে যদিও তিনি ক্ষমা করে দেন, কষ্টের কথা ভুলেন না।
রাসূল (সঃ) বলেন “কোন আগুনই শুকনো কাঠকে এত দ্রুত পুড়ায় না; যত দ্রুত গীবত একজন আবেদের সকল ভাল কাজকে পুড়িয়ে দেয়।”
সাধারনত কারো বিরুদ্ধে ইর্ষা, আক্রোশ, রাগ পোষণ করলে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার মাধ্যমে সে নিজেকে প্রশান্ত করে। আর তাকে এই হেয় করার জন্য তার গীবত করে থাকে। এটা হচ্ছে এমন যে, কারো চোখে যদি ছোট মাছির একটি ডানা পরে, তাহলে সে বিশাল পর্বতকেও দেখতে পায় না। ঠিক তেমনি আমরা আমাদের অপর ভাইয়ের প্রতি ছোট কোন ত্রুটির জন্য যে রাগ পোষণ করি তার জন্য তার শত ভাল কাজকে দেখতে পাই না। মূলত গীবত হচ্ছে সামাজিক জীবনে অশান্তির জন্য একটি বিষাক্ত অস্র। সাধারনত জ্ঞানের স্বল্পতা ও অবিদ্যার কারণেই মানুষ এ ধরনের আত্মঘাতী, পারিবারিক ও সামাজিক প্রশান্তি বিনষ্টকারী ঘৃণ্য গীবতে লিপ্ত হয়।
অনেক সময় গল্প–আড্ডাকে আরও মজাদার, উপভোগ্য করার জন্যও আমরা গীবতের মত কবীরা গুনাতে লিপ্ত হই। মহানবী (সঃ) বলেন, “যে তার ভাইয়ের মর্যাদাকে বিনষ্ট করে’ আল্লাহ তায়ালা শেষ বিচারের দিনে তার মর্যাদা বিনষ্ট করবেন। (তাবরানী)
অন্যত্র রাসূল (সঃ) বলেন, “তোমরা অন্যের দোষ খুঁজো না, কারণ যে অন্যের দোষ খুঁজে, আল্লাহ তার দোষ খুঁজেন।”
আমরা অনেক সময় আমাদের প্রতি অবিচারের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য গীবত করি। গীবত করার মাধ্যমে সমাজে তাকে ছোট করতে চাই, হেয় করতে চাই। অথচ এরূপ ক্ষেত্রে কী করণীয় এ বিষয়ে মহান আল্লাহ সূরা মুমিনুন এর ৯৬ নম্বর আয়াতে বলেন, “(অতএব ওরা যা–ই বলুক বা করুক) তুমি ওদের মন্দের মোকাবেলা করো ভালো কাজ দিয়ে (অন্যায় আচরণের জবাবে ভালো ব্যবহার করো)। আর ওরা তোমার সম্পর্কে যা বলে, তা আমি ভালোভাবেই জানি।”
সূরা হুজুরাত এর ১১ নম্বর আয়াতের এক অংশে মহান আল্লাহ বলছেন, “(সাবধান!)
তোমরা একে অপরের বদনাম করো না। মন্দনামে ডেকো না। মন্দনামে ডেকে একে অন্যকে অপমান করো না।”সূরা হুমাজাহ এর ১ম আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, “দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে, যে সামনাসামনি দুর্ব্যবহার করে এবং পেছনে নিন্দা করে।”
A Complete description of Backbiting. Thanks for this important and valuable article. Hope to get more.