সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আর সুস্থতা তাঁর এক বড় নেয়ামত। স্রষ্টার বাকী সব সৃষ্টি থেকে স্বভাব, কর্ম ও আচরণে মানুষ আলাদা। মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয় ও বিবেক বোধের কারণেই সে আলাদা। মানুষ বুঝতে পারে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়। মানুষ ভালো কাজ করলে যেমন তৃপ্তি পায়, তেমনী অপকর্ম করলেও সে অনুতপ্ত হয়, অনুশোচনা করে। মানুষের একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে যা তাকে বুঝতে শেখায়, ভাবতে শেখায় জীবন বোধ সম্পর্কে।
পৃথিবী ও মহাকাশের বড় বড়, নব নব আবিষ্কার দেখে আমরা বিস্মিত হই। কিন্তু আমরা কী ভেবেছি মানবদেহ সম্পর্কে? মানব দেহের বাইরের কাঠামো, ভেতরের বিচিত্র সব কোষ, হাড়, ধমনী, গ্লান্ড, অরগান, হরমোন, এনজাইম আরো কত কী এগুলো নিয়ে কী ভেবেছি? মুহূর্তের মধ্যে মানবদেহে কতসব ক্যামিক্যাল রিঅ্যাকশন যে ঘটছে তা ভাবাও কষ্টসাধ্য এমকি দুঃসাধ্য। একটি কোষের ভেতরে মাইটোকন্ড্রিয়া, তারমধ্যে উৎপন্ন হয় শক্তি। ভাবা যায়? কিংবা ঘন্টায় ৮-১০ লিটার রক্ত কিডনি অনায়াসেই পরিশোধন করছে, আর দিনে পরিশোধন করছে ১৪৫ গ্যালন। আমরা আর্শ্চয হই ডায়ালাইসিস মেশিন দেখে, অথচ নিজের দেহের ভেতরে যে বিনাখরচায় অটোমিটিক ডায়ালাইসিস চলছে তা লক্ষ করি না। একবার ভাবুন যে চোখের অক্ষপিটে রয়েছে ১০টি রেয়ার, লিভার বা কিডনি অপারেশনের পর আবার আগের সাইজে চলে আসে, শরীরের ৫-৬ লিটার রক্ত প্রতি মিনিটে ৩ বার পুরো দেহ ভ্রমণ করে যার হিসেব দাঁড়ায় ১৯০০ কিমি। শ্বেত রক্ত কণিকা দেহ পাহাড়া দিচ্ছে সকল প্রকার রোগ জীবানুর প্রবেশ ঠেকাতে। আর ডিএনএ? তার কথা আর কী বলবো? আপনার দাদার দাদার দাদার দাদা, যাকে আপনি কোন দিনও দেখেন নাই, তার ইনফরমেশনও আছে আপনার ডিএনএ কোডে। আপনার কোন অঙ্গ বা কোন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে সেই ইনফরমেশন।
কত নিখুত অবয়বে সৃষ্টি করা হয়েছে এই মানব দেহ। এক জিহবা। কী বৈচিত্র তার স্বাদের অনুভূতি! আর ব্রেন? সে নিয়ন্ত্রন করে সমগ্র মানব দেহকে, তার চিন্তা, চেতনা, কাজ ও কথাকে। ব্রেন সম্পর্কে এ লেখাতে নাই বল্লাম। পরে অন্যকোন লেখাতে মস্তিস্ক সম্পর্কে অল্পবিস্তর বলার চেষ্টার করবো ইনশাআল্লাহ।
স্রষ্টা আমাদেরকে অনুগ্রহ করে এত কিছু দিয়েছেন, তা নিয়ে ভাবার সময় পাই না। ভাবি কী নিয়ে? যে আমার কী নাই। আক্ষেপ হয় আমার কেন লেটেষ্ট মডেলের ফোনটা নেই, সবচেয়ে দামী ব্রান্ড এর গাড়ীটা নেই, অভিজাত এলাকায় প্রশস্ত ফ্ল্যাট কেন আমার নেই, ব্যাংক ব্যালেন্স আমার এত কম কেন? নজর শুধু কী নেই সেদিকে। নিজেদের দেহের দিকে তাকাইনা আমরা। অথচ পুরো বিশ্বের সকল অলৌকিকতাকে হার মানায় আমাদের এই দেহ। দেহের ভেতরের প্রতিটি অর্গান এর কর্মকান্ড চলছে কোন রকম কমান্ড ছাড়া, অটোমেটিক। নিরলসভাবে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কাজ করছে আমাদের কোন সক্রিয় বা নিস্ক্রিয় মনোযোগ, কমান্ড বা চেষ্টা ছাড়া। যদি হার্ট, লিভার, কিডনি, ফুসফুস চালানোর নিয়ন্ত্রণ আমাদের নিজেদের হাতে থাকতো, তবে দেখা যেতো যে হার্ট চালাতে গিয়ে কিডনি চালানোর কথা ভুলে গিয়েছি, ফুসফুস চালাতে গিয়ে হরমোন রিলিজ এর কথা ভুলে গিয়েছি। আবার হয়তো দেহের অর্গানগুলো চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, আর কোন কাজ করার সময় পাচ্ছি না।
অথচ আমরা অধিকাংশই এ শরীরের মূল্যদিতে ভুলে যাই, যত্ন নিতে ব্যর্থ হই। আর স্রষ্টার শোকরিয়া করার পরিবর্তে নাশোকর হয়ে যাই। নিজ দেহের প্রতি মনোযাগী না হওয়া, দেহের যথাযথ যত্ন না নেওয়াও নাশোকরিয়া। আমরা সোনার বালার যে পরিমাণ যত্ন নেই, তার অর্ধেক যত্নও নেইনা সেই হাতের যে হাতে সোনার বালা পড়ি। আসলে নিজের সুস্থতার জন্য চেষ্টা করা নিজের যত্ন নেয়া হলো একটি স্বর্গীয় দায়িত্ব।
দেহ ও মনের যত্ন নেয়ার কাজটিকে আমরা বলতে পারি যত্নায়ন। এই যত্নায়ান বলতে দেহে ও মনের সুস্থতার জন্যে যথাযথ মনোযোগ ও বিজ্ঞান সম্মত যত্ন। আমাদের সার্বিক সুস্থতা নির্ভর করে এ যত্নায়নের উপর। আমাদের ভুল খাদ্যাভাস, ভুল জীবনাচরণ, দুশ্চিন্তা, নেতিবাচকতার ফলে আমাদের দেহঅভ্যন্তরে ও মনের ভেতরে নানা রকম টক্সিন বা বিষানুর সৃষ্টি হয়। দেহ ও মনের যত্নায়নের মাধ্যমে এই টক্সিন বা বিষানুকে আমরা বের করে দিতে পারি। আমরা যত্নায়নের এই কাজটি যত কার্যকরভাবে করতে পারবো ততো আমাদের সুস্থতা প্রাবল্য ও প্রশান্তির আবহ বাড়তে থাকবে। আমরা মোটামোটি ৫টি ধাপে দেহ ও মনের সুস্থতা নিশ্চিতে যত্নায়নের কাজটি সম্পন্ন করতে পারি।
১। দম:
দম হচ্ছে জীবনের একক। দমই হচ্ছে জীবন-মৃত্যুর নির্দেশক। দেহ ও মনের যত্নায়নের প্রথম ধাপ হচ্ছে দম। সঠিকভাবে দম নেয়ার মাধ্যমে আমরা দেহকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ ও কার্বনডাই অক্সাইড মুক্ত করতে পারি। সঠিক দম চর্চার উপর আমাদের শরীরে এনার্জি লেভেল নির্ভর করে। দম ঠিক থাকলে সারাদিন কাজ করার পরও আমাদের শরীর থাকবে ক্লান্তিহীন ও কর্মক্ষম। এজন্যে সারাদিন যখনই সুযোগ হয় কয়েকবার করে ফুসফুস ভরে বুক ফুলিয়ে দম নিতে হবে। ধীরে ধীরে নাক দিয়ে দম নিয়ে বুক ফুলিয়ে কিছুটা মুহূর্ত ধরে রেখে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে দম ছাড়তে হবে। দম নেয়ার চেয়ে দম ছাড়ার সময় কিছুটা বেশী নিতে হবে। এভাবে দিনে কয়েকবার করলে আপনি নিজেই আপনার প্রাণবন্ততা দেখে, এনার্জি লেভেল দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। সঠিক পদ্ধতিতে নিয়মতি দম চর্চার উপর আমাদের দেহ মনের সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভরশীল।
২। সঠিক খ্যাদ্যাভাস:
দেহ ও মনের সুস্থতা নিশ্চিত করতে সঠিক খ্যাদ্যাভাস গড়ে তোলা আবশ্যক। খেয়াল রাখতে হবে যে খাবারের মাধ্যমে যেন শরীরে টক্সিন প্রবেশ না করে। শরীরের জন্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক যুক্ত, রঙযুক্ত খাবার, ভাজা-পোড়া, অতিরিক্ত তেল ঝাল যুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার এবং মৌসুমি ফলমূল খেতে হবে। এখনতো পুষ্টিবিদরা বলে মৃতখাবার নয়, খেতে হবে জীবিত খাবার। ভাজা-পোড়া ও অতিরিক্ত সেদ্ধ করা খাবারকে এখন মৃত খাবার বলা হচ্ছে। টক্সিনযুক্ত খাবার, চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার, ধুমপান, ফাস্টফুড, প্রকিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, এনার্জি ড্রিংকস, সফট ড্রিংকস এগুলো সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। সফট ড্রিংকস কিন্তু শরীরের জন্যেও মোটেও সফট হয়। আর ফাস্ট ফুড যত বেশী খাবেন ততো বেশী আপনি মোটা হবেন, ততো বেশী আপনার লিভার ও কিডনি জটিলতা সৃষ্টি হবে, ততো বেশী আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার চান্স থাকবে, ততো সুস্থতা বিঘ্নিত হবে, ততো ফাস্ট মৃত্যুদূত আপনার দিকে এগিয়ে আসবে।
৩। ব্যায়াম:
শরীর ও মনের যত্নায়নে ব্যায়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ধাপ। যোগ ব্যায়াম আমাদের শরীরের হরমোনাল, বায়ো-ইলেকট্রিক্যাল ও নর্ভাস সিষ্টেমের মধ্যে আন্ত:পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রাখে দারুনভাবে। ব্যায়াম, হাঁটা, দৌড়ানো ও কায়িক প্ররিশ্রমের বহুবিধ উপকারীতা ছাড়াও ঘামের সাথে শরীরের অনেক টক্সিন দূরীভূত হয়ে যায়। আর মনের ব্যায়াম হচ্ছে মেডিটেশন। নিয়মিত দু’বেলা মেডিটেশন নিজের মন নিয়ন্ত্রণ, মনের প্রশান্তি ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে অত্যন্ত র্কাযকর ও জনপ্রিয় পদ্ধতি।
৪। হজম:
আমাদের গৃহীত খাবার হজমও একটি গুরুত্বপূর্ণ যত্নায়ন পদ্ধতি। তাই গ্রহন করতে হবে সাপাচ্য খাবার, যা সহজে হজম হয়। খেতে হবে পরিমিত পরিমান। এ বিষয়ে মহানবী (সঃ) এর হাদীস হচ্ছে খাওয়ার সময় পাকস্থলীর এক তৃতীয়াংশ খাবার, এক তৃতীয়াংশ তরল দিয়ে পূর্ণ করো ও এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখো। অর্থাৎ একটু ক্ষুধাভাব থাকতেই খাওয়া শেষ করো। পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে যে এমন খাদ্যাভাসে হজম ভালো হয়।
৫। রেচন:
রেচন প্রক্রিয়া অর্থাৎ প্রসাব-পায়খানার মাধ্যমে শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন নির্গত হয়। শরীর ও মনের সুস্থতার জন্যে এসব বর্জ প্রতিদিন বের হয়ে যাওটা গুরুত্বপূর্ণ। সহজপাচ্য খাবার, ব্যায়াম ও হাঁটা সুরেচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আমাদের শরীরের ৭৫ ভাগ রোগ হচ্ছে মনোদৈহিক। যে রোগগুলোর উৎস হচ্ছে মন কিন্তু প্রকাশ হয় দেহে। আমাদের দুশ্চিন্তা, নেতিচিন্তা, অবৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাস, অসুস্থ বিনোদন, ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি কারণে এই ৭৫ ভাগ মেনোদৈহিক রোগে মানুষ আক্রান্ত হয়। আর বাকী ২৫ ভাগ অসুখ-বিসুখ হয় ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসজনিত কারণে, অপুষ্টি, ভুল ঔষধ ও সার্জারির জটিলতা।
দৃষ্টিভঙ্গিগত ভুলের কারণেও টক্সিন বা বিষাণু সৃষ্টি হতে পারে।আমাদের মনে যদি জটিলতা-কুটিলতা থাকে, আমরা যদি দুশ্চিন্তা-নেতিচিন্তা করি, মনে যদি রাগ-ক্ষোভ, ঈর্ষা-হিংসা পোষণ করি, যদি গীবত-পরচর্চা-পরনিন্দায় অভ্যস্ত থাকি তকে মন বিষানুতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তথাকথিত বিনোদনের ফলেও দেহ ও মনে ষ্ট্রেস ও টক্সিন সৃষ্টি হতে পারে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে আমরা ভায়োলেন্স বা সহিংস সন্ত্রাস, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, পরকীয়া ইত্যাদি দেখেথাকি। আবার গোয়েন্দা কাহিনীতে অপরাধীর কুটকৌশলও দেখানো হয়। এসব ঘটনা বা চরিত্র আমাদেরকে নেতিবাচকভাবে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। একপর্যায়ে বাস্তব জীবনেও অবচেতনভাবে এসব ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে প্রলুব্দকরে। ফলশ্রুতিতে আমাদের ভেতরে সৃষ্টি হয় টেনশন, হতাশা, আসক্তি আর অর্ন্তদ্বন্দ। এসব থেকেও আমাদের দেহের ভেতরে সৃষ্টি হয় টক্সিন নামক ভয়াবহ বিষাণু।
আবার প্রাত্যহিক জীবনে আমরা নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের উপর নির্ভরশীল। টিভি, মোবাইল ফ্রিকোয়েন্সী, স্মার্টফোন, রাউটারসহ নানাধরণের ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে প্রতিনিয়ত রেডিয়েশনের সম্মুখীন হচ্ছি। মোবাইল টাওয়ার থেকে প্রতিনিয়ত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষতিকর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রশ্মি। অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারও আমাদের মনকে বিরক্তি ও বিষাণুতে ভরে তুলছে। অতিরিক্ত টক্সিন এর ফলে আমাদের শরীরে এসিডিক অবস্থা তৈরী হয়। এসিডিক অবস্থার বিপরীত হলো এলকালাইন অবস্থা। আমাদের মন যখন প্রশান্ত থাকে, দেহ যখন সুস্থ থাকে তখন আমরা এই এলকালাইন অবস্থায় থাকি। এলকালাইন অবস্থায় যখন একজন মানুষ অবস্থান করে তখন সে চারপাশে প্রশান্তি ছড়াতে পারে, কল্যাণ চিন্তা করতে পারে, নিজের ও অন্যের জন্যে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আর তাকেই আমরা বলি সৎকর্মশীল ভালো মানুষ। নিজের শরীর সুস্থ না থাকলে, মন প্রশান্ত না থাকলে সে না নিজের কল্যাণ করতে পারে, না পারে অন্যের জন্যে ভালো কিছু করতে। তাই একজন মানুষকে সৎকর্ম করতে হলে, সৎ চিন্তা করতে হলে, অন্যের ভালো করতে হলো নিজেকে ভালো থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে। একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্যে চাই শরীর ও মনের পরিপূর্ণ সুস্থতা। আর সে জন্যে অভ্যস্ত হতে হতে শরীর ও মনের সঠিক যত্নায়নে। রাগ-ক্ষোভ, ঈর্ষা-হিংসা, গীবত-পরচর্চা, নেতিবাচকতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। নিয়মিত যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশনে অভ্যস্ত হতে হবে। কৃত্রিম ও প্যাকেটজাত খাবার বর্জন করে প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হবে।
বুঝতে পারলাম যে আত্মশুদ্ধির জন্যই শরীর ও মনের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। ধন্যবাদ লেখককে।