সালাম চর্চায় শান্তি নিশ্চিত হয় কীভাবে?

সালাম চর্চায় শান্তি নিশ্চিত হয় কীভাবে?

কথারও শক্তি আছে। ভালো কথার শক্তি ইতিবাচক। খারাপ কথার শক্তি নেতিবাচক। ভালো কথা শুনতে কে ভালোনাবাসে? সবাই ভালোকথা শুনতে চায়। ভালোকথা আমাদের মনে দাগ কাটে, মনকে প্রফুল্ল করে। সালাম হচ্ছে একটি ভালো কথা, একটি দোয়া, একটি শুভকামনা। আসলে সালামের শক্তি তার অর্থের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। ‘আসসালামু আলাইকুম’ মানে ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক‘। সালামের যে উত্তর তার অর্থও ‘আপনার ওপরও শান্তি বর্ষিত হোক‘। অর্থাৎ সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা একে অপরের শান্তিকামী, কল্যাণকামী হই। যিনি সালাম দেন আর যিনি সালাম এর জবাব দেন উভয়েই একে অপরের ভালো চান, মঙ্গলচান, প্রশান্তি কামনা করেন। এ কারণে নবীজী (স) বলেছেন, ‘অন্যের প্রতি তোমার ভালবাসার প্রকাশ হচ্ছে সালাম’।

সালাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্যে এক মহা নেয়ামত। আল্লাহ তায়ালা প্রথম হযরত আদম (আ:) কে সালাম শিক্ষা দেন ও ফেরেশতাদেরকে অনুরূপ করার নির্দেশ দেন। তারপর ফেরেশতারা তার উত্তর দেন। সালামের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা জান্নাতে যেতে পারবেনা যতক্ষণ না তোমরা মুমিন হবে। আর মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ না একে অপরকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের এমন একটি আমলের কথা বলে দিবনা যা করলে তোমাদের পরস্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি হবে? (সেটি হলো) তোমরা তোমাদের পরপস্পরের মাঝে ব্যাপকভাবে সালামের প্রচলন করবে।” [মুসলিম ও তিরমিযি] অপর এক হাদিসে রাসূল (স:) বলেন, হে লোক সকল! তোমরা সালামের ব্যাপক প্রচলন কর, (ক্ষুর্ধাতদের) আহার করাও, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখ এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামায পড়, তাহলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে নিরাপদে। [তিরামিযী ও  মুসনাদে আহমাদ] 

এই সালাম দেয়ার মধ্যে ছোট-বড় বয়সের ব্যবধান নেই। উচ্চপদ-নিন্মপদ, নেতা-কর্মী, সাদা-কালোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। নবীজী (স) প্রবীণদেরও যেমন সালাম দিতেন, ছোটদেরকেও সালাম দিতেন। যিনি আগে একাজটি তার র্মযাদা তত বেশি। এ সর্ম্পকে নবীজীর (স) একটি হাদীস হচ্ছে যে, কারো সাথে কারো মনোমালিন্য বা ভুল বোঝাবুঝরি কারণে যদি কথার্বাতা বন্ধও থাকে তবে তা তিন দিনের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং এই দুজনরে মধ্যে সে-ই উত্তম যে আগে সালাম দিয়ে পুনরায় কথা বলা শুরু করে। এই চর্চা পারস্পরিক সুসম্পর্ক নিশ্চিত করে। যিনি আগে দিবেন তিনি অহংকার মুক্ত হন (বায়হাকী) এবং আগে দেয়ার এ চর্চা তাকে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালার নৈকট্য লাভ করে দেয় (আবু দাউদ।

দৈনন্দিন জীবনে নানা পরিস্থিতিতে, নানা সময়ে আমরা এর চর্চা করে থাকি। কাউকে অর্ভ্যথনা জানাতে আমরা সালাম দেই, বিদায় জানাতেও দেই, ঘরে ফিরে পরিবারের সদস্যদের প্রথমেই যেমন শান্তি কামনা করি, ঘর থেকে বেরুনোর সময়ও শান্তি কামনা করেই বের হই। কারো মনোযোগ আর্কষণ করতে, এমনকি আমাদের উপস্থিতি জানাতে সালাম দেই, কারো ফোন রিসিভ করে বা কাউকে ফোন করে প্রথমেই সালাম দেই। সালাম দিতে হবে সঠিক উচ্চারণে ও হৃদয় থেকে শান্তিকামী হয়ে। সালামের উত্তরও দিতে হবে সঠিক উচ্চারণে এবং যিনি সালাম দিয়েছেন তাঁর চেয়ে উত্তম ভাবে। এ বিষয়ে সূরা নিসা’র ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর কেউ যখন তোমাদের সালাম দেয়, তখন তোমরা কমপক্ষে সেরকম অথবা তার চেয়েও বেশি সম্মানসহকারে সালামের জবাব দিবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়েই হিসাব গ্রহণকারী।”

সালামের চর্চা আমাদের জীবনে যত বেশি হবে, জীবন তত প্রশান্তিতে অবগাহন করবে। কারণ একজন ব্যক্তি যখন সারাদিনে যার সাথেই দেখা হবে তার শান্তি কামনা করবে, তখন প্রাকৃতিক ভাবেই তার নিজের শান্তিও নিশ্চিত হবে। অন্যের অকল্যাণ চাইলে, অন্যের বিপদ-অশান্তি চাইলে, সেই বিপদ-অকল্যাণ প্রাকৃতিকভাবে নিজের দিকে ফিরে আসে, অন্যের জন্যে ফাঁদ পাতলে, সে ফাঁদে নিজেকেই পড়তে হয়। একইভাবে অন্যের কল্যাণ চাইলে, মঙ্গল চাইলে, শান্তি চাইলে তাও নিজের জন্যে নিশ্চিত হয়। তাই আমরা যত অন্যকে সালাম দিব, সালামের সঠিক জবাব দিব, অর্থাৎ অন্যের শান্তি কামনা করবো, ততো নিজের শান্তি নিশ্চিত হবে।

শান্তি কামনা করা একটি উত্তম সাদাকা। একবার রাসূল (সঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলো, শান্তির ধর্মে সবচেয়ে উত্তম কাজ কী? জবাবে রাসূল (সঃ) বললেন, ’মানুষকে আহার করানো, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে সকলকে সালাম দেয়া।’ (বোখারী) অর্থাৎ সকল জড়তা-সঙ্কোচ কাটিয়ে সালাম দিতে হবে পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে। আমরা যতবেশি সালামের চর্চা করবো ততবেশি আমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি বাড়বে, বাড়বে চারপাশের মানুষের হৃদয়ের প্রশান্তি।

আজকে চারপাশের মানুষের মধ্যে যে অনাস্থা, অবিশ্বাস, অস্থিরতা কাজ করছে, পরস্পর পরম্পরের প্রতি যে প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে পড়ছে তা থেকে উত্তরণের একটি বড় সমাধান হতে পারে আন্তরিক সালাম চর্চা। কারণ সালাম দেয়া মানে শান্তির জন্যে দোয়া করা। আবার এর উত্তরও হচ্ছে সালাম দাতার শান্তির জন্যে দোয়া করা। তার মানে সালাম দাতা ও গ্রহীতা একে অপরের শান্তির জন্যে প্রার্থনা করেন। তখন দু’জন দু’জনের কাছে নিরাপদ হন। যে আমি আপনার শান্তিকামী, কল্যাণকামী। আপনার জান-মাল, ইজ্জত সবই আমার কাছে নিরাপদ। অমার দিক থেকে আপনার জন্যে অশান্তির কোন কারণ ঘটবে না। এবং আমি দোয়া করি যে স্রষ্টাও আপনার সকল অশান্তি দূর করে প্রশান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আর এভাবে যদি সমাজের প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের জন্যে নিরাপদ হয়, তাহলে সকল অশান্তি দূর হয়ে একটি শান্তির জান্নাতী পরিবেশ সৃষ্টি হবে সমাজে। জান্নাতিদেরও পরস্পর অভিবাদন হবে এই শান্তি কামনা। সুরা ইউনুস এর ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে যে জান্নাতীদের পারস্পরিক অভিবাদন হবে শান্তি! শান্তি! একইভাবে সূরা ওয়াকিয়া’র ২৫-২৬ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “সেখানে তারা কোন বাজে বা পাপকথা শুনবে না। শুধু ধ্বনিত অণুরণিত হবে শান্তি! শান্তি!! আবার সূরা মরিয়ম এর ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “সেখানে তারা সালাম বা শান্তি ছাড়া কোন নির্থক কথা শুনবে না।”

জান্নাতবাসীদের সম্ভাষণ জানানো হবে শান্তি কামনা করে। সূরা হিজর এর ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ সচেতন (পরকালে) তারা থাকবে জান্নাতে, যার পাদদেশে থাকবে প্রবহমান ঝর্নাধারা। (তাদের সম্ভাষণ জানানো হবে) শান্তি! নিরাপত্তা! ভেতরে এসো!” একইভাবে সূরা জুমার এর ৭৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যারা আল্লাহ-সচেতন ছিল তাদেরকে দলবদ্ধভাবে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হবে। জান্নাতের কাছাকাছি পৌঁছলে তোরণ খুলে দিয়ে রক্ষীরা তাদের স্বাগত জানাবে: তোমাদের প্রতি সালাম। তোমরা পরমানন্দে তোমাদের স্থায়ী আবাস জান্নাতে প্রবেশ করো।” জান্নাতে স্রষ্টার পক্ষথেকে বান্দাদের জন্যে থাকবে সালাম। সূরা ইয়াসিন এর ৫৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সোবনাহুতায়ালা বলেন, “এদিন যাদের ঠিকানা হবে জান্নাত, তারা আনন্দে মগ্ন থাকবে, তারা ও তাদের সুযোগ্য সমুজ্জ্বল সাথিরা সুশীতল ছায়ায় অনন্ত শান্তিতে সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়ে বসবে। সেখানে তাদের জন্যে থাকবে সুস্বাদু খাবার, ফলমূল ও কাঙ্খিত সবকিছু। দয়াময় প্রতিপালকের পক্ষ হতে তাদের জানানো হবে সালাম ও সম্ভাষণ।”  একইভাবে সূরা ইব্রাহিম এর ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলরা প্রবেশ করবে জান্নাতে, যার পাদদেশে থাকবে প্রবহমান ঝর্নাধারা। সেখানে থাকবে তারা চিরকাল। সেখানে তাদের প্রতিপালকের পক্ষথেকে অভিবাদন হবে, ‘শান্তি’।” সূরা আহজাব এর ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “বিশ্বাসীরা যেদিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেদিন তাদেরকে স্বাগত জানানো হবে ‘সালাম’ বলে। তিনি তাদের জন্যে মহাপুরষ্কার প্রস্তুত রেখেছেন।” এভাবে কোরআনের বহু যায়গাতে সালাম বিনিময় এর বিষয়টি ফুটে উঠেছে এবং রাসূল (স:) এর জীবনেও সালাম চর্চা ছিল স্বভাবজাত। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেও সালাম চর্চা হউক স্বভাবজাত। চারপাশে বিরাজ করুক শান্তি আর শান্তি। আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.