দানশীল ব্যাক্তি কী প্রভুর প্রিয়ভাজন হতে পারবেন?

দানশীল ব্যাক্তি কী প্রভুর প্রিয়ভাজন হতে পারবেন?

আজকের আলোচনায় দেখব নিজে দানশীল হওয়া, অন্যকে দানে উৎসাহিত করা এবং দান সংগ্রহ করা প্রভুর প্রিয়ভাজন হতে আমাদের কীভাবে সহায়তা করে। আমরা আজকের আলোচনা শুরু করতে পারি একজন সাহাবীর ঘটনা দিয়ে-

আবদুল্লাহ ইবনে জাফর খুব দানশীল একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি একবার নিজের একটা জমি দেখতে গেলেন। মরুভূমির পথ, দুপুরের গরমে তিনি ক্লান্ত হয়ে তার জমির কাছাকাছি পৌঁছে একটি গোত্রের খেজুর গাছের ছায়ায় বসলেন এবং সেখানে একজন ক্রীতদাসকে তার মালিকের বাগান পাহারারত অবস্থায় দেখতে পেলেন।

কিছুক্ষণ পর কৃতদাস খাওয়ার জন্যে তিনটি রুটি বের করল। সে রুটি খাওয়া শুরু করার আগেই একটা কুকুর এসে তার কাছে বসল। ক্রীতদাস একটি রুটি কুকুরকে দিল। কুকুর গোগ্রাসে তা খেয়ে ফেলল। কৃতদাস তাকে আরো একটি রুটি দিল। কুকুর তা-ও খেয়ে ফেলল। অতঃপর কৃতদাস তৃতীয় রুটিটিও দিল এবং এক নিমিষেই কুকুর তা-ও খেয়ে ফেলল। এবং কুকুরটি যখন দেখল আর রুটি নাই তখন সে তৃপ্তি নিয়ে চলে গেল। সাহাবী এতক্ষণ অবাক হয়ে কৃতদাসকে দেখছিলেন। এবার কাছে গিয়ে বললেন তুমি প্রতিদিন কয়টি রুটি খাও? ক্রীতদাস বলল, তিনটি। তখন সাহাবী অবাক হয়ে বললেন, তুমি নিজে না খেয়ে সব ক’টা রুটি কুকুরকে দিয়ে দিলে কেন?

ক্রীতদাস বলল, আমার জানামতে এ অঞ্চলে কোনো কুকুর নেই। এ কুকুরটা নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে এসেছে এবং নিশ্চয়ই খুব ক্ষুধার্ত ছিল। তাই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি নি। তখন সাহাবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজ তুমি কী খাবে? ক্রীতদাস বলল, আজ আমি উপোস করব। তখন আবদুল্লাহ ইবনে জাফর মনে মনে বললেন, এ-তো আমার চেয়েও দানশীল। অতঃপর তিনি ঐ খেজুরের বাগানের মালিকের সাথে দেখা করে  বাগানটিসহ ক্রীতদাসকে কিনে নিলেন এবং ক্রীতদাসকে স্বাধীন করে বাগানটি তাকে উপহার দিলেন।

আসলে পেতে হলে আগে নিজেকে দিতে হবে। যা দান করব তা শতগুণে আমাদের দিকে ফিরে আসবে। অর্থ দান করলে, আমাদের জীবনে অর্থের কখনো অভাব হবে না। কারণ দানের প্রতিদান স্রষ্টা নিজে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। দানের এ প্রতিদান সার্বজনীন, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার জন্যে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারা-র ২৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,  (হে মানুষ!) যে অর্থবিত্ত তোমরা দান করো, সে দান তোমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যেই। তোমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ব্যয় করো। অতএব দানের পুরোপুরি প্রতিদান তোমাদের অবশ্যই দেয়া হবে। তোমাদের হক কখনো নষ্ট করা হবে না।

যখন আমরা অর্থ-সম্পদের অধিকারী হই, সাধারণভাবে মনে করি, আমার সম্পদ আমি পরিশ্রম ও যোগ্যতার বলে অর্জন করেছি। অতত্রব, এর পুরো মালিকানা আমার। এতে কারো হক নেই। আমার সম্পদ আমার ইচ্ছেমতো খরচ করব। কারো কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। অথচ, প্রকৃত সত্য হলো অর্থ-সম্পদ-সম্মান সবকিছুর মালিক পরম করুণাময়। তিনি অনুগ্রহ করে আমাকে তাঁর এই নেয়ামত দিয়েছেন, এজন্যে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ অসহায় বঞ্চিতের কল্যাণে দান করতে হবে সাধ্যমতো। স্রষ্টা যে নেয়ামত দিয়েছেন তার কৃতজ্ঞতা আদায় স্বরূপ দান না করলে পরিণতি কী সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা কলম-এ একটি ঘটনা এভাবে বলা হয়েছে যে, একবার একটি বাগানের মালিকরা ভাবল যে খুব ভোরে তারা বাগানের ফল পেড়ে আনবে। যাতে কোনো অভাবীকে তাদের বাগানের ফল দিতে না হয়। পরদিন খুব ভোরে তাড়াতাড়ি বাগানে পৌঁছল। কিন্তু বাগানে গিয়ে দেখল, পুরো বাগান পুড়ে কালো হয়ে গেছে এবং সব ফল নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঘটনার শিক্ষা হচ্ছে, আমরা যদি দান করতে কৃপণতা করি বা অস্বীকার করি তাহলে স্রষ্টার অপ্রিয়দের তালিকায় আমরা অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাই। প্রভু তখন এভাবেই জীবনে বিপর্যয় দিয়ে দেন। তাই কখনো স্রষ্টার অনুগ্রহের কথা ভুলে যাওয়া যাবে না। 

স্রষ্টার প্রিয়ভাজন হতে হলে আমাদেরকে দানশীল হবে। নিয়মিত দান করতে হবে। যিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন তাকেই নামাজী বলা হয়; যিনি মাঝে মাঝে নামাজ পড়েন তিনি নয়। তেমনি দাতা তিনিই যিনি নিয়মিত দান করেন। আমরা নিয়মিত দান করব। দান করাকে দৈনন্দিন কাজের অভ্যাসে পরিণত করবো। তাহলেই পরকালে মহান স্রষ্টার সামনে দানশীল হিসেবে উপস্থিত হতে পারবো।

দান করব আমাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুসারে। দান হতে হবে আয়ের আনুপতিক হারে। একইভাবে দান করতে হবে নিজের প্রিয় জিনিস থেকে ভালো অংশ। আসলে আমরা যত কুক্ষিগত করে রাখতে চাইব তত প্রভুর করুণা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলব আর যত বিলিয়ে দিতে পারব তত প্রভুর প্রিয়ভাজন হতে পারব। সূরা বাকারা-র ২৬৭ আয়াতে বলা হয়েছে, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যা উপার্জন করো আর জমিন থেকে যা উৎপাদিত হয়, তা থেকে ভালো অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো। বেছে বেছে খারাপ জিনিসগুলো দান করতে যেও না। কারণ যে-জিনিস তোমরা গ্রহণ করতে চাইবে না, তা কখনো দান করতে চাওয়া উচিত নয়। তোমাদের জানা থাকা উচিত, নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবমুক্ত, সর্বোত্তম প্রশংসায় প্রশংসিত।  

স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে, স্রষ্টার প্রিয়ভাজন হতে হলে আগে দানশীল হতে হবে। যারা দানশীল তারা সবসময় অন্যদের চেয়ে বেশি প্রশান্ত, বেশি সুস্থ। সার্বিক অর্থে জীবনে পরিতৃপ্ত। যদিও অন্যদের মতো কখনো কখনো দাতার জীবনেও তুফানের মতো বিপদ আসে তা মিলিয়ে যায় বুদবুদের মতো। 

শুধু নিজে দানশীল হওয়াটাই কী দায়িত্বের শেষ? না, মোটেও তা নয়। সূরা ফজর-এর ১৬-২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যখন তিনি তাকে পরীক্ষা করার জন্যে রিজিক সংকুচিত করেন, তখন সে বলে, আমার প্রতিপালক আমাকে অসম্মান করেছেন। না, একথা সত্য নয়। আসলে (এটা তোমাদের কর্মফল) তোমরা এতিমের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করো না, অভাবী অসহায়কে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত করো না, অন্যের উত্তরাধিকারের সম্পদ নিজেরা আত্মসাৎ করো, আর ধনসম্পত্তির প্রতি তোমাদের আকর্ষণ আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ শুধু নিজে দানশীল হওয়া নয়, অন্যকেও দানশীল হতে উৎসাহিত না করলে আমরা স্রষ্টার প্রিয়ভাজন হতে পারব না। আমাদের রিজিক সংকুচিত হবে, আমরা অভাবগ্রস্ত হবো।

নিজে দান করাটা তুলনামূলক একটি সহজ কাজ। আমার টাকা আছে, আমি দান করে দিলাম। কিন্তু অন্যকে দানে উদ্বুদ্ধ করা এবং তার সেই দান তার কাছ থেকে সংগ্রহ করা নিঃসন্দেহে কঠিন আর এ কারণে এর সওয়াবও বেশি। যিনি দান করছেন তিনি যে পরিমাণ সওয়াব পাচ্ছেন, যিনি অপরকে দাতা হতে উদ্বুদ্ধ করছেন, দান সংগ্রহ করছেন তিনিও সমপরিমাণ সওয়াব পাচ্ছেন। 

দান করতে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ কারো না কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। আর ভালো কাজে মোটিভেশন বা উদ্বুদ্ধকরণের প্রয়োজন অনেক বেশি। কারণ মানুষ যদিও স্বভাবগতভাবে ভালো কাজ করতে চায় বা ভালো কিছুর সঙ্গে জড়িত হতে চায়, কিন্তু শয়তান তাকে ভালো করা থেকে প্রায়ই বিরত রাখে। আবার অনেক সময় মানুষ জানেও না কোথায় গেলে, কী করলে বা কোথায় দান করলে, কীভাবে দান করলে তার কল্যাণ হবে। এই অজ্ঞতার কারণেও মানুষ অনেক সময় কল্যাণ থেকে, স্রষ্টার রহমত থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। 

মুসলিম শরীফের সেই হাদীসের ঘটনাটি আমরা অনেকেই জানি। এটি হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (স) এরশাদ করেছেন, এক আবেদ পাহাড়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় হঠাৎ শুনতে পেলেন যে, অমুকের বাগানে পানি দাও। কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি শুরু হলো এবং পানি পাহাড়ের পাশে একটি নালা দিয়ে গড়াতে লাগল। তিনি কৌতূহলী হয়ে ওই নালাকে অনুসরণ করলেন। কিছুদূর গিয়ে তিনি দেখলেন, একজন কৃষক কোদাল দিয়ে মাটি কেটে বাগানে পানি ঢোকার পথ করে দিচ্ছেন। নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি চমকে উঠলেন। কারণ, এই নামই তিনি শুনেছিলেন পাহাড়ে হেঁটে বেড়ানোর সময়। তার কাছে জানতে চাইলেন যে, কোন পুণ্যের বিনিময়ে প্রকৃতি এভাবে তাকে সহযোগিতা করছে? তিনি তখন বললেন, পুণ্যের কথা আমি বলতে পারব না। তবে আমি এ বাগানের ফসলকে তিন ভাগে ব্যয় করি। একভাগ পরিবারের ভরণপোষণ, একভাগ জমিতে বিনিয়োগ এবং বাকি একভাগ দান করি। এজন্যেই হয়তো আল্লাহ আমাকে এভাবে সাহায্য করছেন। এই হাদীস থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, দানশীলরা কীভাবে হন প্রভুর প্রিয়ভাজন। যারা দান করেন স্রষ্টা তাদের কত পছন্দ করেন।  

যারা নিজেদের ধনসম্পত্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাদের এই সৎদান এমন একটি শস্যবীজ, যাতে উৎপন্ন হয় সাতটি শিষ আর প্রতিটি শিষে থাকে শত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণ প্রবৃদ্ধি দান করেন। আল্লাহ অনন্ত প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। – সূরা বাকারা: আয়াত – ২৬১

আসলে মানুষকে যদি দানে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে না পারি তাহলে তিনি অপব্যয় করবেন। কারণ অর্থ কোথাও স্থবির থাকে না। এর গতি হচ্ছে প্রবহমান। হয় একজন আরো ভোগের জন্যে ব্যয় করবেন নতুবা এমন কিছুর জন্যে ব্যয় করবেন যা ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণ বয়ে আনবে। তাই তার দান সময়মতো গ্রহীতার হাতে পৌঁছে দেয়াটা হলো তার দানের সর্বোচ্চ ব্যবহার।

আমরা যদি শুধু একা দান করি তাহলে কতটুকুই বা দান করতে পারব কিন্তু আমরা যখন আরো মানুষকে দানে উদ্বুদ্ধ করছি, দান সংগ্রহ করছি তখন তাদের করা দানের প্রতিদান আমরাও সমভাবে পাচ্ছি। আমরা প্রতিটি সৎকর্ম করি আসলে স্রষ্টার সন্তুষ্টি পাবার জন্যে। আমরা প্রতিটি ইবাদত করছি তাঁর জন্যেই। কিন্তু আমরা কেউ বলতে পারি না যে সেটা স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে যথেষ্ট কিনা। একজন বুজুর্গের গল্প বলি-

এক শীতের রাত। অন্ধকার পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন একজন মানুষ। লোকে তাকে আল্লাহওয়ালা বলেই জানেন। প্রভুর ইবাদতের কোনো কমতি তিনি করেন না। সেটা সালাতের মাধ্যমে হোক, রোজা রাখার মাধ্যমে হোক বা ধর্মীয় আরো বিধিবিধান মানার ক্ষেত্রে হোক-সবটাতেই তিনি নিয়মিত এবং সচেতন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখলেন, একটি বিড়ালছানা কুঁকড়ে পড়ে আছে। দেখে তার মায়া হলো। যদিও তিনি এ জাতীয় প্রাণি পছন্দ করেন না। তারপরও মায়াবশত তিনি বিড়াল ছানাটিকে চাদরের নিচে বগলে নিয়ে রাখলেন। ঘরে নিয়ে এলেন। তারপরে তাকে আগুনের কাছে রাখলেন। এই ভালো মানুষটি যখন ইন্তেকাল করলেন তখন আরেক আবেদ স্বপ্নে তাকে দেখছেন যে, তিনি বেহেশতে গেছেন। তিনি বলছেন যে, আপনি যে বেহেশতে যাবেন এটা তো আমরা জানি। আপনি এত ইবাদত করেছেন। তিনি বললেন যে, আমার ইবাদতের জন্যে আল্লাহতায়ালা আমাকে বেহেশত দেন নাই। তাহলে কীসের জন্যে? বললেন যে, আমার কোনো আমলের জন্যে না। একটি ছোট্ট কাজের জন্যে, যেটাকে আমি কোনো কাজই মনে করি নাই। কী কাজ? তিনি বেড়ালের ঘটনাটি বললেন। 

তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে, এই কাজটির জন্যে তিনি আমাকে ক্ষমা করেছেন। ঐ যে শীতের রাতে এ বিড়ালটার প্রতি সমমর্মী হয়েছিলে। বিড়ালটাকে তুমি পছন্দ করো না, তারপরও তুমি সেটাকে অন্য কিছু না পেয়ে তোমার চাদরের নিচে, বগলের পাশে রেখেছিলে। যাতে ওটার ঠান্ডা না লাগে। এটাই হচ্ছে মমতা। এই মমতাটা হচ্ছে স্রষ্টার একটা গুণ। আর যারা এমন মমতাময় হতে পারেন তারাই হন স্রষ্টার প্রিয়ভাজন।  আসলে স্রষ্টার প্রিয়ভাজন হতে হলে আমাদের কাজ করতে হবে সহমর্মিতা নিয়ে। আর দানের চর্চা আমাদের মাঝে এই মমত্ববোধ সৃষ্টি করে। তাই আসুন আমরা সবাই আমাদের চারপাশের প্রতিটি মানুষকে স্রষ্টার প্রিয়ভাজন হতে সৃষ্টির সেবায় দানে উদ্বুদ্ধ করি। সবার প্রতি সমমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেই। পরম করুণাময়ও একইভাবে আমাদের প্রতি তার রহমত ও বরকত বাড়িয়ে দেবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *