আসলে সুস্থ জীবন, সফল জীবন, সুন্দর জীবন, কল্যাণ এ ভরপুর জীবন আমরা সবাই চাই। আর সবচেয়ে ধনী সে-ই যার সুস্বাস্থ্য আছে। সুস্থতা যার যত বেশি, সে তত ধনী। এখন এই সুস্থতার দুটো দিক আমরা জানি। এক, দৈহিক সুস্থতা। দুই, মানসিক সুস্থতা। মানসিকভাবে সুস্থ থাকা মানে প্রশান্তিতে থাকা, সুখী হওয়া। আর এরকম সুখী জীবন লাভে অন্যের কল্যাণে কাজ করা, সময় দেয়া যে কীভাবে সহায়ক হতে পারে, আজ সেটাই আমরা শেয়ার করার চেষ্টা করব। কারণ, এখন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাই বলছেন যে, আপনি যদি ভালো থাকতে চান তাহলে কী খাচ্ছেন, কোন ব্যায়াম করছেন, এগুলোর সাথে সাথে দেখতে হবে আপনি কীভাবে সময় ব্যয় করছেন।
বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে-ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। এ কথাটা তাদেরকেই তাচ্ছিল্য করে বলা হয় যারা ঘরে এসে খাওয়া-দাওয়া করে, কিন্তু তারপরই বেরিয়ে পড়ে পাড়া-পড়শী, মানুষের কল্যাণ করতে। তবে সাম্প্রতিককালের বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায় যারা তাদেরকে তাচ্ছিল্য করবেন না। কারণ এরা খুব সৌভাগ্যবান। এরা কোনোরকম প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই চারপাশের মানুষের ও সমাজের কল্যাণে নিয়মিত কাজ করেন। এর ফলে তাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা বাড়ে। কমে হতাশা, বিষন্নতা ও একাকিত্বের অনুভূতি। এজন্যে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখন পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকদের যে, আপনারা রোগীর সুস্থতার জন্যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের পাশাপাশি তাদেরকে সামাজিক কল্যাণের কাজেও যুক্ত থাকতে বলুন।
একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখবো যে, যেদিন কোন অসহায় দুস্থকে দান করি কিংবা চলার পথ থেকে কোন কাঁটা বা পথিকের জন্যে পরে থাকা ক্ষতিকর কোন জিনিস সরিয়ে দেই বা গণপরিবহনে চলার পথে কোন নারী বয়স্ক ব্যক্তিকে নিজের আসন ছেড়ে দেই তখন নিজের অজান্তেই কেমন যেন একটা আনন্দ আনন্দ ভাব কাজ করে, নিজেই নিজেকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে। হৃদয়ের ভেতর থেকে তৃপ্তির হাসি পায়। অন্যের জন্যে কল্যাণ কাজ করলে যে নির্মল সুখ সুখ অনুভূতি হয়, সেখান থেকেই এই হাসি আসে। এই যে সুখবোধ এটা কেন হয়? কারণ পরার্থে বা অন্যের কল্যাণে কোন কাজ করতে পেরেছি। এই অনুভূতি সুস্থ শরীর ও প্রশান্ত মনের জন্যে খুবই জরুরী। এই অনুভূতি যে শরীরে একটি বস্তু তৈরি করে ফেলেছে, বিজ্ঞানীরা তা খুঁজে বের করতে পেরেছেন। সেটি হচ্ছে সেরোটনিন ও এন্ডোরফিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার ও হরমোনের প্রবাহ বেড়ে যায় যখন এই সুখানুভূতি সৃষ্টি হয়। আর এই হরমোন বাড়া মানে বিষণ্নতা ও দুশ্চিন্তার মতো নেতিবাচক আবেগের ঝুঁকি কমা। রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়া। দেহ-মনকে চনমনে ও গতিময় করা। সাইকোলজি টুডে সাময়িকীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগী মেলন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আরেকটি জরিপ। তাতে দেখা গেছে, বছরে অন্তত দুশো ঘণ্টা স্বেচ্ছাশ্রমে ব্যয় করেছেন এমন স্বেচ্ছাসেবীদের রক্তচাপ/ ব্লাড প্রেশার আগের তুলনায় কমেছে। কারণ, হাই ব্লাড প্রেশার বা উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ স্ট্রেস। আর মানবকল্যাণে কাজ স্ট্রেস কমায়। ফলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। যে কারণে এখন সেখানে বয়স্করা সেবামূলক কাজে যুক্ত হচ্ছেন।
তবে এখানে দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূরর্ণ বিষয়। কল্যাণ কাজ করা থেকে উপকৃত হওয়া বা না হওয়ার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির। অর্থাৎ একটি কাজ করলে পরে আমি তৃপ্ত হবো, সুস্থ হবো, প্রশান্ত হবো নাকি মেজাজ বিগড়ে যাবে, ক্লান্তিতে শরীর ডুবে যাবে এটি নির্ভর করছে আমি কোন উদ্দেশ্যে, কোন নিয়তে, কী কাজ করছি। কাজটির ব্যাপারে নিয়ত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কাজটির ধরনও গুরুত্বপূর্ণ। ভালো কাজ ভালো মন নিয়ে করলে ফল নিজের ও অন্যের জন্যে ভালো হবেই। এ নিয়ে একটি চমকপ্রদ তথ্য দিই!
সারা পৃথিবীতে ইদানীং আলঝেইমার্স রোগটির প্রাদুর্ভার বেড়েছে। ৬৫ বছর বা এরচেয়ে বেশি বয়সীরা স্মৃতিভ্রষ্টতায় ভুগছেন। অথচ সেবাকাজে যুক্ত থাকলে কমতে পারে স্মৃতিভ্রষ্টতা! বার্ধক্যবিষয়ক চিকিৎসা-সাময়িকী জার্নাল অব জেরোন্টোলজি-তে বলা হয়েছে এ নিয়ে। একদল বয়োবৃদ্ধ নান-কে নিয়ে হয়েছিল গবেষণা। তারা নিবেদিত ছিলেন সেবাধর্মে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তারা শিশুদের পড়িয়েছেন, জটিল ধাঁধার সমাধান করেছেন, গাড়ি চালিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা-নেয়া করেছেন। তাদের মৃত্যুর পরে তাদের মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে গবেষকরা দেখেন, এদের এক-তৃতীয়াংশের মস্তিষ্কই ছিল আলঝেইমার্সের উপসর্গে আক্রান্ত।
২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের ‘রয়েল ভলান্টারি সার্ভিস’ পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, সঙ্ঘবদ্ধ সেবাকাজে উৎসাহী মানুষেরা পরিণত বয়সে বিষণ্নতা ও একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেন। কারণ, কয়েকজন মিলেমিশে তারা যখন কাজ করেন, এটি তাদেরকে এই অনুভূতি দেয় যে, আমার পাশে স্রষ্টা তো আছেনই, আরো অন্যান্যরাও আছেন। এই পাশে থাকার অনুভূতি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। মানসিক জোর বাড়ায়।
স্বেচ্ছাশ্রমে যে বয়স্করাই উপকৃত হচ্ছেন তা নয়। কানাডায় ১৬০ জন শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার পর তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা ও অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। কারণ, কাজ করলে তো স্বাভাবিকভাবেই হাঁটা, দৌড়ানো, চলাফেরা হয়। বাড়তি ওজন হওয়ার সুযোগ কোথায়!
শুধু শারীরিক সক্ষমতা নয়, শৈশব থেকে যারা সেবাকাজে অংশ নেয়, তারা জীবনের বহু পরিস্থিতি সামলে নেয়ার মানসিক শক্তি লাভ করে। এ কাজ করতে করতে তাদের নৈতিকতা, মানবিকতা, মূল্যবোধও গড়ে ওঠে। যে কারণে অন্যায় কাজের হাতছানিতে তাদের অংশগ্রহণ প্রবণতা কমে আসে। এ কারণেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভর্তি প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাসেবার অভিজ্ঞতা আছে এমন শিক্ষার্থীদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
আমাদের সময় এক দিনে কত? ২৪ ঘণ্টা বা ১,৪৪০ মিনিট বা ৮৬,৪০০ সেকেন্ড। সবার জন্যেই এটুকু বরাদ্দ। এই সময়ে নিজের খাওয়া, পরা, ঘুম, গোসলসহ প্রাত্যহিক আবশ্যিক কাজগুলো আছে। সেইসাথে আছে রুটি-রুজির জন্যে কাজ মানে পেশাগত দায়িত্ব। যাদের পারিবারিক দায়িত্ব আছে তাদেরও বেশ খানিকটা সময় চলে যায় বাজার করায়, ঘর সামলানোয়, রান্না করায়। অবশিষ্ট যে সময়টুকু থাকে, সেটার পরিমাণও খুব বেশি নয়। যতটুকুই হোক, এটুকু সময়ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আসলে এই সময়টুকুই নিজের একান্ত কিছু সময়। এই সময়টাতে আমরা কী করছি, তা-ই প্রভাবিত করে আমাদের বাকি সময়টার কাজগুলোর ব্যাপারে আবেগকে। এই সময়টায় আমরা যদি এমন কিছু কাজ করি, যা আমাদের মনটাকে ভালো রাখে, তাহলে সেই উদ্দীপনা নিয়ে আমাদের পরের অন্যান্য কাজগুলোও ভালো হতে বাধ্য। আসলে সময়ের মতো সময় চলতেই থাকবে। এই সময়ে আমি কী করছি বা কী করতে চাই সেই প্রায়োরিটি ঠিক করতে হবে নিজেকেই।
কল্যাণ কাজের পুরস্কার যে পরম করুণাময় দেবেন তা তিনি বলে দিয়েছেন। সকল ধর্মবাণীই এই কথা বলে। ভালো কাজের জন্যে থাকবে পুরস্কার, আর মন্দ কাজের জন্যে অপেক্ষা করছে করুণ পরিণতি। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের যে আমরা কোন কাজের পেছনে ছুটে কী ফলাফল পেতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি যে, সবাই আমরা কল্যাণকাজই করতে চাই। আসলে কত সময় যে এ পৃথিবীতে থাকব জানি না। তাই সময় থাকতেই যেন আমরা অর্থ দিয়ে হোক, সময় দিয়ে বা শ্রম-ঘাম দিয়ে অংশগ্রহণ করি সৃষ্টির সেবায়। এই সেবার মধ্য দিয়ে যে লালন করব স্রষ্টার সৃষ্টিদেরকে, ইনশাল্লাহ এরাই শেষ বিচারে আমাদের পরিত্রাণের জন্যে সুপারিশ হয়ে দাঁড়াবে। এটি তো পরম করুণাময়ের প্রতিশ্রুতি। সকল ধর্মের নির্দেশনা এটিই। কাজ করো মানুষের কল্যাণে, এর মধ্য দিয়ে নিজের কল্যাণ করো। যাতে আমাদের শেষ বিদায়ে সবাই অন্তত এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে বলতে পারেন-বড় ভালো মানুষ ছিলেন। এটিই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হয়ে থাকবে। ইতিহাস আমাদের অমর করে রাখবে, বেঁচে থাকব আমরা লাখো মানুষের হৃদয়ে।