প্রার্থনা হলো সকল ইবাদতের নির্যাস। স্রষ্টা প্রার্থনা পছন্দ করেন ও তা কবুল করেন। প্রার্থনাই পারে স্রষ্টার অবারিত রহমতের দ্বার উম্মুক্ত করতে, সকল অসম্ভবকে সম্ভব করতে।
একটি গল্প দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করা যাক। এক লোক চুল কাটতে গেল সেলুনে। সেলুনে চুল কাটার সময় সাধারণত যেমনটি হয়, তেমনি নরসুন্দরের সাথে লোকটির গল্প জমে গেল। এ গল্প থেকে সে গল্প, এমন করে স্রষ্টা আছেন কি নাই এমন আলোচনায় চলে গেল তারা।
হঠাৎ করে নরসুন্দর বলে উঠল, “আমি বিশ্বাস করি স্রষ্টা বলে কেউ নেই”। লোকটি তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এমনটি বললে কেন?”
নরসুন্দর লোকটি বলল, “তুমি অন্ধ নাকি? এখান থেকে রাস্তায় বের হয়ে গিয়ে দেখো, দেখবে স্রষ্টা বলে কেউ নেই। যদি এমন কেউ থাকতই তবে এতো মানুষ অনাহারে কষ্ট পেতো না। আমাকে বলো, স্রষ্টা বলে যদি আসলেই কেউ থাকত তবে কি এতো মানুষ অসুখে কষ্ট পেত? এমনকি দুধের শিশুরাও বাদ যায় না। যদি স্রষ্টা বলে আসলেই কেউ থাকত, তবে কেউ কষ্টে থাকত না। কষ্ট পেত না। আমি বুঝি না, যদি কেউ স্রষ্টা বলে কেউ থাকতই তবে নিজের সৃষ্টিকে এমন কষ্ট কেউ দিতে পারে কী করে?”
চুল কাটাতে আসা লোকটি একটু ভাবল এবং চুপ করে থাকল। সে কোনো যুক্তি তর্কে যেতে চাইল না। চুল কাটা শেষ হলে লোকটি দোকানের বাইরে এলো। বাইরে আসার পর উস্কোখুস্কো লম্বা জট পাকানো ময়লা চুলের-দাড়ির এক লোককে দেখতে পেল রাস্তায় দাঁড়িয়ে। দোকানে ফিরে লোকটি নরসুন্দরকে বলল, “তুমি জানো কি এ এলাকায় কোনো নরসুন্দর নেই”।
নরসুন্দর অবাক হয়ে বলল, “কী সব বাজে বকছ? এ এলাকায় নরসুন্দর থাকবে না কেন? এই মাত্রই তো আমি তোমার চুল কেটে দিয়েছি”। এবার লোকটি বাইরের লম্বা জট পাকানো লোকটিকে দেখিয়ে বলল, “তাহলে নরসুন্দর থাকার পরও কীভাবে এমন নোংরা লম্বা জট পাকানো চুল নিয়ে এ এলাকায় কেউ থাকে?” নরসুন্দর লোকটি জবাব দিল, “তাকে তো আমার কাছে আসতে হবে চুল কাটতে। নাকি?” আমাদের জীবনে যা-কিছু প্রয়োজন, তা পাওয়ার জন্যেও মুখাপেক্ষী হতে হবে প্রথমে স্রষ্টার কাছে।
প্রার্থনা মানে কী? আমাদের কিছু চাওয়া, যা আমরা পেশ করছি স্রষ্টার কাছে। স্রষ্টা প্রার্থনা পছন্দ করেন এবং অবিচল বিশ্বাস নিয়ে সেই প্রার্থনা করলে, সেইসাথে প্রার্থনা পূরণের জন্যে নিরলস পরিশ্রম করলে তা কবুলও করেন তিনি। শুধু অনুভব করতে হবে যে, সর্বশক্তিমান প্রভুর সামনে নতজানু হয়ে/ সেজদায় পড়ে আছি আমরা। তিনি আমাদেরকে দেখছেন, আমাদের সব কথা শুনছেন। আমাদের প্রার্থনা কবুল হয়ে গেছে। এই অনুভূতি যখন আমাদের মনে সৃষ্টি হয়, তখন পাওয়ার আর কিছু বাকি থাকে না। কিছু প্রর্থনা সাথে সাথে কবুল হয়, কিছু প্রর্থনা কবুল হতে কিছুটা সময় প্রয়োজন হয় আর কিছু প্রর্থনা ইহকালে অপূর্ন থাকলেও পরকালে তা বহুগুণে দেয়া হবে।
আমাদের সব প্রার্থনাই কিন্তু আমাদের জন্যে কল্যাণকর নয়। যদিও আমরা মনে করি যে নিজের জন্যে সবচেয়ে ভালোটাই প্রার্থনা করছি। অনেক সময় মনে করি যে এটা না পেলে, ওটা না পেলে বা অমুক কে আমার জীবনে না পেলে জীবন অর্থহীন হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে স্রষ্টাই ভালো বোঝেন বান্দার জন্যে কোনটা কল্যাণকর আর কোন কল্যাণকর নয়। আবার কল্যাণকর জিনিসটিও কখন পেলে আমার জন্য কল্যাণকর হবে, কখন পেলে তা অমঙ্গল হবে তা স্রষ্টাই ভালো বোঝেন। একটি জিনিস শুধু পেলেইতো হবে না, সেটাকে কাজে লাগানোর সুযোগ, সময় ও যোগ্যতার প্রয়োজন রয়েছে। অর্থ্যাৎ প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। তানাহলে, পেলেও ধরে রাখা যাবেনা বা সেটা থেকে কল্যাণ পাওয়া যাবে না। সূরা বনি ইসরাইল এর ১১ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, (হায়) মানুষ (অনেক সময়) যাতে তার অকল্যাণ হবে, এমন বিষয়ের জন্যে এত একাগ্রভাবে প্রার্থনা করে যেন সে কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করছে। আসলে মানুষ (সিদ্ধান্ত নিতে) অতিমাত্রায় তাড়াহুড়ো করে। তাই চাইতে হবে শুধু মাত্র স্রষ্টার কাছে। আর চাওয়ার পর তা পাওয়ার জন্যে তাড়াহুড়ো করা যাবে না, অস্থির হওয়া যাবে না। বরং চাওয়াটাকে পাওয়ায় পরিণত করার জন্যে যেমন প্রার্থনায় লেগে থাকতে হবে, তেমনই নিরবে কাজ করে যেতে হবে। সবর করতে হবে।
আসলে কাতর হৃদয়ে মানুষের একান্ত চাওয়াতে স্রষ্টা এভাবেই সাড়া দেন। এজন্যে আমাদের প্রত্যেককেই একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। লক্ষ্য হতে হবে নিজের জন্যে কল্যাণকর, অন্যের জন্যেও কল্যাণকর। সেই লক্ষ্য যেন অর্জন করতে পারি, সেজন্যে হৃদয় নিংড়ানো আকুতি নিয়ে প্রভুকে বলতে হবে। প্রভুকে বলার সময় ভুলে যেতে হবে আর সবকিছু। দিনের কিছু সময় এইভাবে প্রার্থনার জন্যে নির্দিষ্ট করে ফেলতে হবে। আমাদের মধ্যে যখন এরকম শুদ্ধ চাওয়া সৃষ্টি হবে, যদি সত্যিই এর মধ্যে কল্যাণ থাকে, তাহলে তাকে অবশ্যই পূর্ণতা দেবেন পরম প্রভু-এ বিশ্বাস নিয়ে বলতে হবে। তবে এখানে একটি বিষয় আছে। তিনি জানেন কীসে আমাদের কল্যাণ আর কীসে আমাদের অকল্যাণ। সেজন্যেই তো সূরা বনী ইসরাইলের ৮০ নম্বর আয়াতে প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে, ’আমার প্রতিপালক। তুমি আমাকে যেখানেই নাও সত্য ও কল্যাণের সাথে নাও। আর যেখান থেকেই ফিরিয়ে নাও, সত্য ও কল্যাণের সাথে ফিরিয়ে নাও। তোমার কুদরতি শক্তি দিয়ে আমাকে সাহায্য করো।’ যে জন্যে আমরা প্রার্থনা করছি, তাতে আমাদের কল্যাণ থাকলে প্রভু নিশ্চয়ই তা আমাদের জন্যে কবুল করবেন এবং তা না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।
প্রার্থনার রয়েছে অফুরন্ত শক্তি। কিন্তু শুধু প্রার্থনা করেলেই চলবে না; প্রত্যাশাকে প্রাপ্তিতে পরিণত করার জন্যে অনুরূপ কাজ করতে হবে, কাজে লেগে থাকতে হবে। তাই আমরা একাগ্রতা নিয়ে প্রার্থনা যেমন করব, তেমনি তা পূরণের জন্যে লেগেও থাকব, কাজও করব। সেইসাথে অন্যের জন্যেও প্রার্থনা করব। ১৯৮৮ সালে সান ফ্রান্সিসকো জেনারেল হসপিটালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ১০ মাস ধরে ভর্তি আছেন এমন ৩৯৩ জন হৃদরোগীকে নিয়ে একটি গবেষণা চালান ডা. রানডল্ফ বায়ার্ড। দৈব-চয়নের মাধ্যমে রোগীদেরকে দুটো গ্রুপে ভাগ করে এক গ্রুপের জন্যে নিয়মিত প্রার্থনা করতে বলা হলো দেশজুড়ে নিয়োজিত প্রার্থনাকারীদের। আরেক গ্রুপের জন্যে চলল শুধু প্রচলিত চিকিৎসা। দুই গ্রুপের কাউকে এমনকি ডাক্তারদেরও এ বিষয়ে কিছুই বলা হলো না। বিস্ময়করভাবে দেখা গেল, যে গ্রুপের জন্যে প্রার্থনা করা হয়েছে অন্য গ্রুপের চেয়ে আগে তারা হাসপাতাল ছেড়েছেন, তাদের এন্টিবায়োটিক লেগেছে মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এবং তারা পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ ক্ষেত্রে।
প্রার্থনা বা দোয়ার শক্তি এতটাই। তাই সবসময় সবার জন্যে দোয়া করব। খাবার গ্রহণের শুরুতে ও শেষে যারা এই প্রস্তুতের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন, চাষী থেকে রাঁধুনি সবার জন্যে দোয়া করব। সেই রিকশাচালকের কথা মনে পড়ল, যার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম দশ বছর আগে। তার জন্যে দোয়া করব। এই দোয়ার ফলে আমরা দায় থেকে মুক্ত জীবনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। আর যেহেতু আমরা অন্যের ভালোর জন্যে কাজ করছি, প্রাকৃতিক নিয়মেই আমরা ভালো থাকব। আমাদের অন্তরে প্রশান্তি আসবে।
কীভাবে আমরা ভালো থাকব? একটু অন্যভাবে আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করতে পারি। আমরা জানি আমাদের মস্তিষ্ক একইসাথে চিন্তার ট্রান্সমিটার ও রিসিভার। আমরা যদি অন্য কাউকে বদদোয়া দেই বা অকল্যাণ কামনা করি, আমাদের ব্রেন নিজেও সেটা রিসিভ করে। যদি মিস্টার এক্স-এর জন্যে গর্ত খুঁড়ে কামনা করি-মিস্টার এক্স গর্তে পরুক, মিস্টার এক্স গর্তে পরুক। আমাদের ব্রেন ভাববে শুধু মিস্টার এক্স কেন? হোয়াই নট মি? আমি নই কেন! ব্রেন আমাদের গর্তে ফেলার ব্যবস্থা করে দেবে। বিপরীতভাবে আমরা যখন অন্যের জন্যে দোয়া করব, অন্যের কল্যাণ কামনা করব। আমাদের ব্রেনও কিন্তু সেটা রিসিভ করবে এবং যাতে আমাদের ভালো হবে, ব্রেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সেই পথে পরিচালিত করবে। আসলে আমরা যত অন্যের ভালো চাইব, আমরা নিজেরাই তত উপকৃত হবো। তত আমরা প্রশান্তি পাবো। আমরা জানি, মনে প্রশান্তির পথে সবচেয়ে বড় শত্রু আত্মবিনাশী প্রোগ্রাম-রাগ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, হিংসা ইত্যাদি। এখন কেউ যদি আপনার সাথে ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ ব্যবহার করে, আপনাকে কষ্ট দেয়, অপমান করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার মাঝে রাগ-ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। আবার ঈর্ষা-হিংসাও মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। নিজের ছেলে/ মেয়ে এ প্লাস না পেলে আমাদের খারাপ লাগে, কিন্তু এই খারাপ লাগা বহুগুণ বেড়ে যায় যখন শুনি প্রতিবেশীর ছেলে/ মেয়ে ঠিকই এ প্লাস পেয়েছে। আমরা হয়তো সচেতনভাবে ঈর্ষামুক্ত থাকতে চাই, কিন্তু তারপরও আমরা দেখি কারো কারো আনন্দের সংবাদে আমরা সেই অর্থে খুশি হতে পারি না। বাইরে খুশির ভান করি কিন্তু বুকে ঠিকই একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করি। কারণ যা-ই হোক না কেন, দোষ যারই হোক না কেন এই দুঃখ, কষ্ট, ঈর্ষা, হিংসা শেষ পর্যন্ত আমাদের নিজেরই ক্ষতির কারণ হয়। আমাদের প্রশান্তি নষ্টের কারণ হয়। এগুলো থেকে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম হতে পারে তাদের জন্যে দোয়া। হয়তো কেউ আপনাকে কষ্ট দিয়েছে, আপনি তার জন্যে দোয়া করুন যেন তিনি ভালো মানুষ হতে পারেন। কারো খুশির সংবাদে আপনার মনে ঈর্ষার সৃষ্টি হয়েছে? আপনি সাথে সাথে তার জন্যে দোয়া করুন। আন্তরিকভাবে দোয়া করুন, দেখবেন আপনার কষ্ট লাগা দূর হয়ে গেছে। আপনার মাঝে প্রশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। তাই কাউকে ভালো লাগলে তার জন্যে দোয়া করব, কাউকে ভালো না লাগলে তার জন্যে আরো বেশি করে দোয়া করব। কাউকে আনন্দে দেখলে তার জন্যে দোয়া করব, আর কাউকে কষ্টে দেখলে তার জন্যে তো অবশ্যই দোয়া করব।
প্রার্থনা করতে হতে দৃঢ়তার সাথে, পরিপূর্ন বিশ্বাস নিয়ে। রাসূল (সঃ) বলেন, “যখন তোমরা দোয়া করবে, তখন পরিপুর্ন বিশ্বাস নিয়ে দোয়া করবে। অন্তর থেকে চাইবে। কারণ আল্লাহ বান্দাকে যা দেবেন, তা তাঁর কাছে বিশাল কিছু নয়।” তাছাড়া স্রষ্টা নিজেও তাঁর কাছে আমাদেরকে প্রর্থনা করতে উৎসাহিত করেছেন এবং প্রার্থনা কবুলের আশ্বাস দিয়েছেন। সূরা মুমিন এর ৬০ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন – ”তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেবো (দোয়া কবুল করব)। যারা অতি-অহমিকায় আমার ইবাদতে বিমুখ, তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।“ আবার সূরা মুমিনুন এর ১১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা আমাদের তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে বলছেন, “অতএব (হে বিশ্বাসীগণ! কায়মনোবাক্যে) প্রার্থনা করো, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমায় ক্ষমা করো! আমায় দয়া করো! তুমিই সত্যিকার দয়াময়!’ আবার প্রার্থনা কীভাবে করবো সে বিষয়ে মহাগ্রন্থ কোরআনে বলে দিচ্ছেন, ‘(হে বিশ্বাসীগণ!) বিনয়াবনত চিত্তে ও সংগোপনে তোমার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করো। তিনি সীমালঙ্ঘন কারীদের অপছন্দ করেন।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-৫৫)। আর স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা যে শুধু আমরাই করি তা নয়, বরং প্রতিটি সৃষ্টিই তাঁর কাছে প্রার্থনা করে এবং পবিত্র কোরআনে সূরা আর রাহমান এর ২৯ নম্বর আয়াতে মহান স্রষ্টা বলেন, ‘মহাবিশ্বের সবকিছুই তাঁর ওপর নির্ভরশীল, তাঁরই নিকট প্রার্থনা করে। সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর মহিমা নব নবরূপে দীপ্যমান।’ আসলে আল্লাহর কাছে নিবেদিত প্রার্থনাই সত্যিকারের প্রার্থনা।
আল্লাহ মহান মঙ্গলময়। তিনি সকলের মঙ্গলজনক প্রার্থনা কবুল করুন। আমিন।