যাকাত আদায় করা ইসলামের মৌলিক বিধি বিধানের অন্যতম একটি। পবিত্র কোরআনে যেখানেই নামাজের কথা বলা হয়েছে তার সাথে সাথে যাকাত আদায়ের জন্যে বলা হয়েছে। বিদায় হজের ভাষণে রসুলুল্লাহ (স) বলেন, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে। নামাজ কায়েম করবে, রোজা রাখবে, যাকাত আদায় করবে, হজ আদায় করবে আর সঙ্ঘবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে, তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
জান্নাত লাভ করা-এ প্রাপ্তি তো ওপারের জীবনে। এপারের জীবনে যাকাতের পুরস্কার কী? সূরা বাকারা-র ২৭৭ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আর যারা বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীল, নামাজ কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তাদের জন্যে রয়েছে উত্তম পুরস্কার। তাদের কোনো ভয়, পেরেশানি ও দুঃখ থাকবে না।’ কারণ, একজন যাকাতদাতা যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বঞ্চিতের যে হক তার সম্পদে ছিল তা আদায় করে স্রষ্টার নির্দেশ পালন করেন। তাই অবশ্যই স্রষ্টার করুণা ও রহমত তার জন্যে থাকবে। সাধারণ যুক্তিতেই যদি দেখি, আমাদের তত্ত্বাবধানে যারা কাজ করেন, তাদের মধ্যে যারা যারা আমাদের নির্দেশনা অনুসারে করেন, তাদেরকে আমরা পছন্দ করি বেশি। আর যারা এদিক-ওদিক করে, হয়তো মুখে কিছু বলি না, কিন্তু মনে মনে তার ব্যাপারে একটি ধারণা থেকেই যায় যে, তার মধ্যে অমান্য করার প্রবণতা আছে। তার ব্যাপারে খুব যে খুশিমনে থাকি, তা বলা যাবে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমার টাকা, আমার উপার্জন; যদি কোনো উপরি না খাই, সৎভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করি, এটাতো হালাল, বৈধ। তারপরও কেন প্রতি বছরে আড়াই শতাংশ হারে অর্থ দিয়ে এই সম্পদকে হালাল করতে হবে? এই প্রশ্ন আছে কারো কারো মনে। বিশেষ করে ঐ হাদিসটি পড়ার পরে যে কারো মনে এ প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে। নবীজী (স) বলেছেন, ‘যাকাতের সুনির্ধারিত অংশটি শরীয়ত সম্মতভাবে আদায় না করলে গোটা সম্পত্তিই মুমিনের জন্যে হারাম হয়ে যায় এবং যাকাতের অংশ যে সম্পত্তির সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকবে তা তার ধ্বংসের কারণ হবে।’ নির্ধারিত পরিমান আদায় করলে অবশিষ্ট সম্পদ শুদ্ধ হয়। যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র করা, পরিশুদ্ধ করা। সম্পদের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিকর্তাই দিয়ে দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে সূরা কাহাফের ৭-৮ আয়াতে আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা বলেন – (হে মানুষ!) কর্ম ও আচরণে কে উত্তম, তা পরীক্ষার জন্যই আমি জমিনের উপর সকল (আকর্ষণ ও) সৌন্দর্য়কে সৃষ্টি করেছি। এই আকর্ষণ যখন আসক্তিতে পরিণত হয় তখনই হয় সমস্যা। ব্যক্তি আত্মিক ভাবে কলুষিত হয়, সমাজ কলুষিত হয়। সম্পদের আকর্ষণ যখন হৃদয়ে ঢুকে যায় তখন আত্মিক শুন্যতা দেখা দেয়। মন ও আত্মা অপবিত্র হয়ে যায়। যাকাতের বিধান সম্পদের মোহ থেকে মানুষের মন ও আত্মাকে পবিত্র করে। তাই পবিত্র কোরআনে সূরা তওবার ১০৩ নাম্বার আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন – আর (হে নবী!) তুমি তাদের ধনসম্পত্তি থেকে যাকাত গ্রহণ করে তাদেরকে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধির পথে এগিয়ে দাও।’
এটিই আল্লাহর অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বিধান করে দিয়েছেন যে, তোমরা যা কিছু উপার্জন করো না কেন তা ভোগ করার এখতিয়ার পুরোটা তোমাদের নেই। যখনই উপার্জন একটি সীমা পার হয়ে যাবে, তখন সেখানে অভাবী ও অসহায়দের অধিকার চলে আসবে। এই অধিকার আদায়ই হলো যাকাতের বিধান পালন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ যাকাতের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে বলেছেন ২.৫% । এই ২.৫% অংশ যদি এক বছরে দেয়া হয়, তাহলেই পবিত্র হয়ে গেল আমাদের সম্পদ। পবিত্রতার মধ্য দিয়ে বরকত আসবেই। তা শুধু যাকাতদাতার হবে না, বরং যারা গ্রহণ করবেন তাদের জীবনেও বরকত আসবে। আর সঠিক হিসেব করে পুরোপুরি তা আদায় না করলে অবশিষ্ট সকল সম্পদ অপবিত্র হয়ে যায়। এবং এটা অন্যের হক অর্থাৎ আল্লাহর হক, দরিদের হক মেরে খাওয়া হয। সুনিদৃষ্ট সম্পদ থেকে সুনিদৃষ্ট হিসাব করে, সুনিদিৃষ্ট খাতে যাকাত আদায় করতে হবে। আবার যাকাত আদায়ের প্রকৃয়াও হতে হবে সঠিক। অর্থাৎ যাকাত গ্রহীতার কাছথেকে কোন ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায় যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না। হতে পারে যে তাকে যাকাত দিলে সে আমাকে সমীহ করবে, আমাকে সালাম দিবে, আমার কাজে সহযোগীতা করবে, আমার বাসায় গৃকর্মী হিসেবে থাকবে, আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে, আমাকে নির্বাচনে ভোট দিবে, আমার পক্ষে কথা বলবে এরকম আরো বহু সুবিধার আশা করা হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে যাকাত আদায় হবে না। আবার তথাকথিত শাড়ি, লুঙ্গি, সেমাই-চিনি যাকাত হিসেবে দিলেও যাকাত আদায় হবে না।
যাকাত ফরজ হওয়ার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র বিমোচন। যাকে যাকাত দেয়া হবে, সে যেন দরিদ্র না থাকে, প্রতিবছরান্তে যাকাত পাওয়ার আশায় না থাকে। বরং যাকাতের টাকায় সে যেন স্বনির্ভর হয়, স্বাবলম্বী হয় সে পরিমান যাকাত দিতে হবে এবং মনিটর করতে হবে যে সে যাকাতের টাকা দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ব্যবহার করছে কিনা। তাহলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেও যাকাত দাতা হয়ে উঠতে পারবে। এভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একসময় দারিদ্রতা দূর হবে। তবে এই লক্ষকে পুরেপুরি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ করতে হবে সঙ্ঘবদ্ধভাবে। এটিই আসলে আল্লাহ নির্ধারিত যাকাতের সঠিক প্রক্রিয়া। নবীজীর (স) সময়েও সেই আলোকে যাকাত ফান্ড গঠন করা হয়েছিল। তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখন জরিপ করা হয়েছিল যে, কাদের কাদের ওপরে যাকাত ফরজ হয়েছে। তারপর তাদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কী পরিমাণ ফরজ হয়েছে, সেই পরিমাণ তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যাকাত কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যাকাত সংগ্রহ করে কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। আবার দরিদ্র শ্রেণির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কী পরিমাণ দরিদ্র আছে? কার কী সমস্যা আছে? সেগুলো নোট করা হয়েছে। নবীজীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। ইয়া রসুলুল্লাহ (স) আমরা যাকাত সংগ্রহ করেছি। গ্রহীতার সংখ্যাও পরিষ্কার। কী পরিমাণ যাকাত দেব? নবীজী (স) বলেছেন একটি কথা-পুরা করে দাও। সম্মিলিতভাবে, পরিকল্পিতভাবে যখন যাকাত বিতরণ করা হলো, ঐ বছর থেকেই দরিদ্রদের সংখ্যা কমেছে, ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। হযরত ওমর (র)-এর সময় এসে আর ঐ এলাকায় যাকাত গ্রহীতা কাউকে পাওয়া গেল না। সবাই ধনী হয়ে গেল। একটু আগে আমরা যেরকম বলছিলাম যে, আদি ইবনে হাতিম তাইকে নবীজী (স) একথা বলেছিলেন।
ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বিমোচনে যাকাতের চেয়ে ভালো সিস্টেম আর কিছু হতে পারে না। নবীজীর (স) সময়কার একটি ঘটনা বলি। হাতিম তাইয়ের ছেলে ছিলেন আদি ইবনে হাতিম। ঘটনাচক্রে তার বোন যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন তার ভাইকেও বার বার বলতে লাগলেন যে, তুমিও আসো, দেখো, তোমার ভালো লাগবে। আদি ভাবলেন, এতবার করে যখন বলছে, ঠিক আছে, একবার যাই। আদি এলেন, নবীজীর (স) সাথে দেখা করতে। তখন নবীজী (স) আরবের রাষ্ট্রপ্রধান। আদি-র সন্দেহপ্রবণ মন বার বার তাকে প্রশ্ন করাচ্ছে যে, ভালো করে খেয়াল করো, উনি রাজা হওয়ার জন্যে এতসব করছেন নাকি সত্যিই তিনি রসুল।
আদি দেখলেন, এক মহিলা বাচ্চা কোলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নবীজীর (স)-র সাথে কথা বলছে। দীর্ঘসময় ধরে তার বক্তব্য পেশ করছে আর নবীজী (স) মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আদি দেখছেন আর ভাবছেন, রাজা হলে তো এভাবে এত সময় তিনি কাউকে দিতেন না। মহিলার কথা শেষে তিনি আদিকে নিয়ে তার তাবুতে এলেন। ভেতরে বসার জন্যে একটিই কুশন ছিল, সেটা এগিয়ে দিলেন আদির দিকে, নিজে বসলেন মাটিতে। কেন? আদি মেহমান। আদি এবার কিছুটা নিশ্চিত হলেন যে, ইনিই সত্য নবী। তারপরও মনে খটকা, ইসলাম গ্রহণ করবেন কি করবেন না। নবীজী (স) বললেন, আদি, তুমি গোত্রের প্রধান। তুমি হয়তো মনে করছ যে, যে লোকগুলো ইসলাম গ্রহণ করছে এরা তো সব দরিদ্র, দাস শেণির। সেজন্যে তুমি ইসলাম গ্রহণে দেরি করছ। কিন্তু তুমি যদি জীবিত থাকো, তাহলে তিনটি বিষয় দেখবে তোমার নিজ চোখে। (এক) এই দাসশ্রেণির মুসলিমরাই একসময় রোমান এবং পারস্য সাম্রাজ্যের অধিপতি হবে। (দুই) ইরাকের হিরা বলে একটি স্থান থেকে মহিলারা একা চলে আসবে কাবাঘর তাওয়াফ করতে। (তিন) আরবে যাকাত নেয়ার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না। আদি ইসলাম গ্রহণ করলেন। আদি তার জীবদ্দশায় পারস্য বিজয় অভিযানে একটি দলের সেনাপতি ছিলেন এবং মহিলাদের একা তাওয়াফ করে আবার নিরাপদে ফিরে যাওয়াকে নিজ চোখে দেখেছেন। তার মৃত্যুর পরে খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের সময়ে তৃতীয় ঘটনাটি ঘটল। যখন আরবের সমস্ত শহরবাসীরা একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত যাকাত দেয়ার জন্যে লোক খুঁজেছে। চিৎকার করে বলেছে যে, কে আছ যাকাত নেয়ার, আস। যাকাত দেয়ার কোনো লোক পায় নি। এত সম্পদের প্রাচুর্য ছিল! কেন? কারণ ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমে গিয়েছিল। আল্লাহতায়ালা যাকাত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ধনীদের ওপরে ট্যাক্স ধার্য করলেন, গরিবের ওপরে কিন্তু কোনো ট্যাক্স নাই। ট্যাক্স হচ্ছে অর্জিত সম্পদের ওপরে। যা ব্যয় করে ফেললেন সেটার ওপরেও ট্যাক্স নাই। বাড়ি-গাড়ি যা ব্যবহার করছেন সেটার ওপরেও ট্যাক্স নাই। সারা বছরের ব্যয় নির্বাহ করার পর বছরান্তে যে সুনির্দিষ্ট পরিমান অর্থ মহান আল্লাহর কৃপায় একজনের কাছে অতিরিক্ত থাকবে তা থেকে ২.৫% যাকাত হিসেবে আদায় করতে হবে। দেখুন কত দূরদর্শিতা আল্লাহর! কত সুন্দর আল্লাহর বিধান।