সময়, পরিকল্পনা ও কাজ এই তিনটি বিষয়ের যোগফল হচ্ছে জীবন। তিনটি বিষয়ের একটি হলো কাজ। যতটুকু সময়ের জন্যে এই জীবনকে আমরা যাপন করার সুযোগ পাই, সে সময়কে অর্থবহ করে তোলে আসলে কাজ। তবে কাজ হতে হবে সুকাজ, ভালো কাজ, নিজের ও অন্যের জন্যে কল্যাণকর কাজ।
আসলে কাজ হচ্ছে দুই ধরনের।
১. ভালো ও কল্যাণকর কাজ।
২. খারাপ ও অকল্যাণকর কাজ।
ভালো কাজ করলে ভালো পাবো, মন্দ করলে মন্দ পাবো। ভালো কাজে স্রষ্টার রহমত থাকবে আর মন্দ কাজে শয়তানের ছায়া থাকবে। ভালো কাজ বা কল্যাণকর কাজ হলে তা থেকে আত্ম উপলব্ধি আসে, সত্যকে অনুধাবনের সুযোগ আসে এবং সেই কাজের প্রতিদান কোনো না কোনো সময় আসবেই। সেটা অর্থ ও সম্পদের প্রাচুর্য় হতে পারে, সম্মান ও মর্য়াদা হতে পারে, সেটা পরিচিতি হতে পারে, শারীরিক সুস্থতা ও মানষিক প্রশান্তি হতে পারে। সে প্রতিদান দক্ষতা সৃষ্টির মাধ্যমেও হতে পারে। যা অন্যের জন্যে কল্যাণকর এবং নিজের জন্যেও কল্যাণকর, সেই কাজ মানুষকে ক্লান্তও করে না। বলবেন, বৈজ্ঞানিক কারণটা কী? আসলে আমরা ভালো বা মন্দ যে কাজই করি না কেন তা আমাদের সুপার কম্পিউটার ব্রেনকে ব্যবহার করে করি। প্রতিটি চিন্তা বা কাজ ব্রেন গ্রহণকরে কমান্ড হিসেবে। যখন আমরা কল্যাণকর কাজ করছি তখন ব্রেন প্রতি মুহূর্তে মন থেকে পজিটিভ সিগন্যাল পাচ্ছে এবং আমাদের জন্যে কল্যাণকর বাস্তবতা তৈরিতে নেমে পড়ছে। আবার যখন কেউ ক্ষতিকর কোনো কাজ করছেন তখন ব্রেন নেগেটিভ সিগন্যাল পাচ্ছে এবং তার জন্যে নেগেটিভ বাস্তবতা তৈরি করছে। এজন্যে বলা হয় যে, অন্যের জন্যে গর্ত করলে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়।
সেইসাথে নিজের কাছে পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন যে, আমি যে কাজ করছি সেটি কি শোষকের সহযোগিতার জন্যে করছি না শোষিতের পাশে দাঁড়াব বলে করছি। কেউ যদি মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করেন বা প্রতারণার সাথে জড়িত থাকেন, তাহলে যত বেশি পরিশ্রম করুন না কেন, হয়তো টাকা থাকবে অনেক, কিন্তু মনের শান্তি আসবে না, শরীরের ক্লান্তি দূর হবে না, মানসিকভাবেও সারাক্ষণ বিপর্যস্ত হবেন। হয়তো তারাই মৃত্যুর মুখোমুখি এসে আফসোস করে বলবেন-হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছুকাল সময় দিলে না কেন? তাহলে আমি সৎকর্ম করতাম ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। কিন্তু (মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা মুনাফিকুন-এর ৯-১১ নাম্বার আয়াতে বলেন যে,) তোমাদের তখন আর কোনো সময় দেয়া হবে না।
কীভাবে কাজ করতে হবে তার প্রথম এবং প্রধান কৌশল বলা আছে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যেই। সেটি হচ্ছে ভালবাসা। যা করব, ভালবেসে করব। যা করব, আনন্দ নিয়ে করব। যা করব, হাসিমুখে করব। মমতার সাথে করবো। যখনই হাতে নতুন কোন কাজ আসবে, শোকরিয়া আদায় করতে হবে। হাতে কাজ আছে, কাজ করার সামর্থ আছে এই জন্য স্রষ্টার শোকরিয়া আদায় করতে হবে।
এবারে তাহলে চলে আসি আমাদের প্রতিদিনের যে কাজ, সে কাজের বরকত, কাজের প্রতিদান যেন আমরা যে-রকম চাই, সে-রকম হয়, সেজন্যে ভালবাসার সাথে সাথে আর কী কী করণীয় সে প্রসঙ্গে।
প্রথমেই বলব, কাজের উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। এটাকে নিয়তও বলতে পারি। বোখারী শরিফের হাদীস হচ্ছে যে, নবীজী (স) বলেন, নিয়ত সকল কর্মের অঙ্কুর। নিয়ত অনুসারেই কর্মফল পেতে হবে। বুদ্ধবাণীতেও একই সুর আমরা দেখি। পবিত্র ধম্মপদের যমকবগগো : ১-২ এর সরল বাংলা হচ্ছে-চিন্তা বা অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটে স্বভাব বা প্রকৃতিতে। যদি কেউ মন্দ অভিপ্রায় নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে দুঃখ তাকে অনুগমন করে। আর কেউ যদি সুচিন্তা নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে সুখ তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। কল্যাণকর কাজের চিন্তা করতে করতে কাজে নেমে পড়লেই অর্জন আসতে থাকে।
একটি প্রাচীন গল্প বলি। চীনদেশের এক রাজপুত্র। তার বিয়ে নিয়ে রাজ-জ্যোতিষী একটি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। হবু কনে হবে ভিনদেশী, ভিন্নভাষী। সে আসবে পূর্ণিমার এক রাতে, সমুদ্র থেকে। তার চেহারাও হবে আলাদা মানে চীনাদের সাথে কোনো মিল থাকবে না। তার একটি গুণ থাকবে। সেটি হচ্ছে সে তাঁবু বানাতে পারবে।
এবার চলুন দেখি হবু কনে কোথায়? কী তার নাম, কী তার পরিচয়? তার জন্ম তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। থাকত সমুদ্রপারে। বাবা ছিলেন তাঁতি। বাবার কাছ থেকে সে-ও তাঁত বুনতে শিখেছে। কিন্তু তার স্বপ্ন ভিন্ন। সে হতে চায় রাজরাণী, তবে প্রজাদরদী। সে তার ঐশ্বর্যকে ব্যয় করবে দুস্থ-বঞ্চিতদের কল্যাণে। কিন্তু ভাবলে কী হবে, তার সারাদিন যায় তাঁত বুনতে আর ঘরের কাজ করতে। এক গরিব তাঁতিকন্যার তুলনায় রানি হওয়ার স্বপ্নটা অনেক বড় বৈকি। কিন্তু সারাদিন সব কাজের মাঝেই তার এই একটিই চিন্তা। একসময় তার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে বাবা তাকে নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন। গন্তব্য মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকাডুবি হলো। মেয়েটি হারিয়ে গেল তার বাবার কাছ থেকে। সমুদ্রতীরে এক বৃদ্ধ জেলে তাকে খুঁজে পেল। নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। সেখানে সে শিখলো দড়ি পাকিয়ে জাল বুনতে।
কিছুদিন পর আবার তার জীবনে নেমে এলো দুর্বিপাক। জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে বিক্রি করলো বসরার এক সওদাগরের কাছে ক্রীতদাসী হিসেবে। সওদাগরের ছিল জাভা থেকে কাঠ আমদানি করে নৌকা বানানোর ব্যবসা। সেখানে সে আয়ত্ত করলো কাঠ চেরাই আর মাস্তুল বানানোর প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যে কয়েকবার জাহাজডুবিতে সওদাগরের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলো। লোকজন তাকে ছেড়ে চলে গেল। তখন বুদ্ধিমতী ও বিশ্বস্ত সেই মেয়েটি দাঁড়ালো তার মনিবের পাশে। মনিব তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ব্যবসায়ে অংশীদার করলেন। মেয়েটি কাঠ আনতে সমুদ্র পথে জাভার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু আবার ঝড়, আবারও নিরুদ্দেশ হয়ে ভেসে যাওয়া। এবার সে গিয়ে পড়লো চীন দেশে। জ্ঞান ফিরে সে দেখলো, মহাসমারোহে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাজপ্রাসাদে।
কেন বলুন তো? গল্পের শুরুতে সেই রাজ-জ্যোতিষীর কথা তো মনে আছে আপনাদের। এখন ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ভিন্ন ভাষী, ভিনদেশী, অন্য চেহারা, সমুদ্র থেকে আসা, তা-ও পূর্ণিমার রাতে-এ সব মিলে গেলেও বাকি ছিল একটি শর্ত। তাঁবু বানাতে পারা।
মেয়েটি নেমে পড়লো তাঁবু বানাতে। কাপড় বোনার অভিজ্ঞতা থেকে কাপড় বানালো। জাল বানানোর অভিজ্ঞতা থেকে দড়ি বানালো। আর মাস্তুল বানানোর অভিজ্ঞতা থেকে বানালো তাঁবুর খুঁটি। তাঁবু তৈরি হলো। রাজা নিশ্চিত হলেন যে, এই মেয়েটিই তার হবু বৌ-মা। পূরণ হলো আমাদের গল্পের নায়িকা ফাতিমা-র আজন্ম লালিত স্বপ্ন।
আমাদের ফাতিমা-র কাছে কোনো জাদুর চেরাগ ছিল না। তাহলে তার অর্জনের রহস্য কী ছিল? কর্মপ্রেম, কাজ শেখার আগ্রহ। অনেক বাধা এসেছিল, তারপরও লেগে থেকেছেন। একসময় বিজয় তার পদচুম্বন করেছে। আসলে আমরা কাঁধে যত বেশি দায়িত্ব নেবো, যত বেশি কাজ করব, ততই আমাদের কাঁধ মজবুত হবে, আমাদের ওপর আরো বড় বড় দায়িত্ব আসবে, আমাদের সাফল্যের রেখা আরো ঊর্ধ্বগামী হবে।একবার এক বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কীসের ভিত্তিতে আপনি নতুন দায়িত্ব দেন।তিনি বললেন, যিনি অফিসে সবচেয়ে ব্যস্ত তাকেই দায়িত্ব দেই। কারণ তিনি জানেন দায়িত্ব কীভাবে পালন করতে হয়। যারা দায়িত্ব নেয় না তাদের কাছে দায়িত্ব আসেও না। আসলে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই সাফল্যের সিঁড়ি ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বগামী হয়। আয়েশি লোক কখনো শক্তির জাগরণ ঘটাতে পারে না, জীবনে বড় কিছু করতে পারে না। একটা জোক বলি।এক ভদ্রলোক প্রতিদিন দেরি করে অফিসে আসেন এবং অফিস ছুটি হওয়ার আগেই বাড়িতে যান। একবার একজন তাকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে যান কেন? তিনি উত্তর দিলেন, আমি একদিনে দুইবার দেরি করতে চাই না? মানে দেরি করে আসছেন, আবার দেরি করেও যাবেন, না না, তা হবে না। আসলে কাজের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক না থাকলে সে কাজে বরকত হয় না।
ধরুন, যার কাছে রান্না মানে একটা শিল্প, তার কাছে রান্না কিন্তু ভালবাসা এবং তিনি যদি খুব সাধারণ কিছুও রান্না করেন, দেখা যায় সবাই খুব তৃপ্তির সাথে খাচ্ছেন। তিনি সামান্য আলুভর্তা আর ডাল রান্না করলেও মনে হয় অমৃত। মশলার চেয়ে তার মমতা তখন রান্নার স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। আবার আরেকজন হয়তো পোলাও-কোর্মা রান্না করছেন, কিন্তু যারা খাচ্ছেন ঠিক স্বস্তি পাচ্ছেন না। কারণটা কী? কারণ কেউ কেউ রান্না করেন একরাশ বিরক্তি নিয়ে।
একইভাবে যিনি শিক্ষকতা পেশায় আছেন, যিনি চাকরি করছেন, যিনি গবেষণা করছেন, যিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন খেলাকে, সবার রুটি-রুজির ব্যবস্থা এর মাধ্যমে হলেও যতক্ষণ না এই কাজগুলো তাদের ভালবাসায় রূপান্তরিত হচ্ছে, ততক্ষণ তারা পরিচিতিও সৃষ্টি করতে পারেন না। আর কাজটাই যখন ভালবাসা হয়ে যায়, তখন কী হয়?
কাজের প্রথম প্রাপ্তি হচ্ছে অভিজ্ঞতা। ধরা যাক একজন কিশোরকে একটা নতুন কাজ করতে বলা হলো যা এর আগে সে করে নি। তাকে হয়তো বলা হলো বাজার থেকে গরম মশলা নিয়ে এসো। এটা আনতে গিয়েই সে জানলো যে, গরম মসলা মানে ঠিক উষ্ণতা অর্থে গরম নয়। এলাচি দারচিনি লবঙ্গ ইত্যাদিকে একসাথে গরম মশলা বলে। এই কাজটা করতে গিয়ে তার প্রথম যে প্রাপ্তি তা হচ্ছে অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে সে একটি সেবা করারও সুযোগ পেল। কারণ, রান্নার পরে সবাই তৃপ্তি করে খেলেন। তখন এটা হয়ে গেল সেবা। কিন্তু প্রথম প্রাপ্তি হচ্ছে অভিজ্ঞতা। আর এরকম ছোট্ট ছোট্ট অভিজ্ঞতাই একজনকে এগিয়ে নিয়ে যায় সাফল্যের পথে, সুস্থতার পথে। শুধু যে অভিজ্ঞতা, সেবা তা নয়; কাজ করলে নিজের শারীরিক উপকারও হয় অনেক। আমরা যখন কর্মহীন অবস্থায় থাকি তখন আমাদেরকে বিভিন্ন প্রকারের টেনশন এসে হানা দেয়। অতীত নিয়ে আফসোস আর ভবিষ্যতের বিষয় নিয়ে আতঙ্কিত করে। বর্তমান-যার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত, এই নগদকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করতে বাধা দেয়। আর যদি আমরা কাজে ব্যস্ত থাকি তাহলে এই সকল অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকা যায় আর বর্তমান সময়ের ফলপ্রসূ ব্যবহার করে ভবিষ্যতকে আলোকিত করা যায়। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ-এর একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা নিয়মিত কাজে ব্যস্ত থাকেন তাদের উচ্চ রক্তচাপ ৭৫ ভাগ কমে যায়। নিয়মিত পরিশ্রমে ক্যালরি বার্ন আউট হয়। ফলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তাহলে দেখা যাচ্ছে কাজ করার মাধ্যমে অর্থ, খ্যাতি, প্রভাব, প্রতিপত্তি, শরীরিক সুস্থতা, মানষিক প্রশান্তি সহ নানা ধরনের প্রাপ্তি ঘটে থাকে। তবে কাজ হতে হবে ভালো কাজ অর্থাৎ সৎকর্ম।
Absolutely right.
খুব সুন্দর লিখেছেন