প্রথমেই দেখাযাক কল্যাণচিন্তা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।আমাদের বাস্তবতা আমাদের চিন্তারই ফল। চিন্তা যদি নিজের ও অন্যের জন্যে কল্যাণকর হয়, প্রাকৃতিক নিয়মেই কল্যাণ আমাদের দিকে আকৃষ্ট হয়। আর বিপরীত চিন্তা বিপরীত শক্তি, অকল্যাণকর শক্তি আমাদের দিকে আকৃষ্ট হয়। প্রকৃত অর্থে জনে জনে চিন্তার বিষয় ও চিন্তার ধরণ ভিন্ন ভিন্ন হয়। একজন ব্যস্ত ব্যবসায়ীর চিন্তা তার ব্যবসার মুনাফা নিয়ে, একজন গৃহিণীর চিন্তা তার ঘর-সংসার-পরিজন নিয়ে, একজন অফিস কর্মকর্তার চিন্তা তার অফিস ডিলিংস নিয়ে, একজন শিক্ষার্থীর চিন্তা তার পড়াশোনাসহ নিজেকে তৈরি করার আরো খুঁটিনাটি নিয়ে, এমনকি একটি শিশুরও চিন্তা আছে। তার চিন্তার বেশিরভাগ জুড়েই থাকে তার খেলনা। যে কারণে আরেকটি শিশু তার সাথে খেলতে এলেও সে খেয়াল রাখে নিজের খেলনা যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায়। সেইসাথে যদি আরো কিছু খেলনা উপহার হিসেবে পাওয়া যায় কারো কাছ থেকে-এই আশাবাদী চিন্তাও তার থাকে।
তার মানে আমরা কেউই চিন্তার বাইরে নই। মানে চিন্তামুক্ত নই। কারো চিন্তা আশাবাদী, কারো চিন্তা নৈরাশ্যের। কারো চিন্তা ইতিবাচক, কারো চিন্তা নেতিবাচক। কারো চিন্তা গঠনমূলক, সৃজনশীল আর কারো চিন্তা ধ্বংসাত্মক। এই যে চিন্তার ঢেউ, কখনো ঊর্ধ্বমুখী, আবার কখনো নিম্নগামী, এটাই সহজভাবে মেনে নিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে সাজাতে চাই। যা যা যুক্তিসঙ্গত চাওয়া, তা পেতে চাই। সুখ চাই, শান্তি চাই, প্রাচুর্য চাই, সাফল্য চাই, নিরাময় চাই, ভালো রেজাল্ট চাই, ঘরে সুখ চাই, আনন্দময় কাজ দিয়ে পেশাজীবন সাজাতে চাই, আত্মিক শান্তি চাই, পরম করুণাময়ের নৈকট্য চাই, প্রাণভরে সেজদা দিতে চাই বা প্রণতি জানাতে চাই। তবে সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো, এই চাওয়াগুলো পাওয়ার জন্যে ইতিবাচক হতে চাই।
যদিও বেশিরভাগ মানুষই আসলে নেতি-টাই আগে ভাবেন, নেতিচিন্তাটাই তাদের মনে প্রথমে কাজ করে। যেমন ধরুন, রাত ১২টার দিকে ফোন এলো। রিসিভ করার আগেই ফোনসেট ধরতে না ধরতেই আমরা ভাবি, এত রাতে ফোন! কোনো দুঃসংবাদ না তো! দেখা গেল, ফোনের ওপাশ থেকে ওয়াও! ওয়াও! শব্দ আসছে (নবজাতকের কান্নার শব্দ)। মানে কি? নতুন একজন মানুষ এই মাত্র পৃথিবীতে এসেছেন। এটা তো সুসংবাদ। তাহলে কেন খামোখা আশঙ্কা করলাম ফোন ধরার শুরুতে? ঐ যে, মনটা নেতিচিন্তায় ভরে গেছে। আমাদের জীবনের অনেক নেতিবাচক বাস্তবতা ঘটেও আসলে এরকম নেতিবাচক চিন্তার ফলে।
একটা গল্প বলি। গল্পটি এক বাবা এবং তার ছেলের। বাবা এবং ছেলে একদিন এক জঙ্গলের পথে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। পথটা ছিল পাহাড়ি পথ। হঠাৎ করেই ছেলে হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। ব্যথায় সে চিৎকার করে উঠল- আহহহ …. বলে। তখন সে খুব বিস্ময়ের সাথে শুনল পাহাড় থেকে তার কণ্ঠের মতোই একটা শব্দ আসছে। আহহহ…. তখন সে খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল তুমি কে? কিন্তু উত্তরে শুনতে পেল কণ্ঠটি বলছে, তুমি কে? এই উত্তর শুনে সে বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি একটা ভীরু! আর সেই কণ্ঠটিও তখন উত্তর দিল তুমি একটা ভীরু! তখন ছেলেটি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা এসব কী হচ্ছে? তখন বাবা ছেলেকে বললেন, তুমি একটু মনোযোগ দাও। তাহলে বুঝতে পারবে যে কী হচ্ছে।
তখন বাবা চিৎকার করে বললেন, তুমি অনেক ভালো। তখন সেই কণ্ঠটিও বলল, তুমি অনেক ভালো। বাবা আবার বললেন, তুমি খুব সুন্দর। এবং কণ্ঠটিও তখন চিৎকার করে বলল, তুমি খুব সুন্দর। ছেলেটি তখনো বিস্মিত। কারণ সে বুঝতে পারছে না যে এসব কী হচ্ছে। কেন তারা যা বলছে কণ্ঠটিও তা-ই বলছে। তখন তার বাবা তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললেন, মানুষ এটাকে বলে প্রতিধ্বনি। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে আমাদের জীবনটাও এমনই। জীবন তোমাকে সবসময় তা-ই দেবে যা তুমি জীবনকে দেবে। ভালো চিন্তা করবে, ভালো ফল হবে। মন্দ চিন্তা করবে, মন্দ পরিণাম ঘটবে।
ভালো চিন্তা, ভালো কথা, ভালো আচরণ সবটা মিলেই আমাদের অর্জনের ঝুলি বাড়তে থাকে। যেমন ধরুন, একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম হওয়া, এটি যে কত বড় প্রাপ্তি, কত বড় নেয়ামত এটা কারা বোঝেন? যাদের কোনো না কোনো কারণে সুস্থ সন্তান হয় না। বিজ্ঞানীরা, গবেষকরা বছরের পর বছর তাদের অবজারভেশন থেকে দেখেছেন যে, গর্ভাবস্থায় যেসব মা খুব বেশি স্ট্রেস-আক্রান্ত ছিলেন, পরবর্তীতে তারা অস্থিরমতি, অপরিণত ও স্বল্প ওজনধারী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, অটিজমের আশঙ্কা তো রয়েছেই। কারণ, স্ট্রেস ও নেতিবাচক আবেগ মায়ের শরীরে যে কর্টিসোল হরমোন নিঃসৃত করে, তা গর্ভের সন্তানকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। অন্যদিকে ইতিবাচক চিন্তা, ভালো কথা, অটোসাজেশন, মেডিটেশন এবং গর্ভকালীন পুরোটা সময় একটি সুস্থ, প্রাণবন্ত, ফুটফুটে সন্তানের চিন্তা মায়ের শরীরে আনন্দবর্ধক হরমোন এন্ডোরফিনের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। মায়েরা যত প্রশান্ত থাকেন, সন্তান তত মেধাবী, প্রত্যয়ী ও সাহসী হয়ে ওঠে। এগুলো শুধু দুয়েকটি বাচ্চার ক্ষেত্রে নয়, ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল, এই ২২টি বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ১.৩৮ মিলিয়ন শিশুর ওপর তাদের মায়ের চিন্তা, কথা ও মানসিক অবস্থার প্রভাবকে শনাক্ত করেছেন। যে কারণে দেখুন যে মায়েরা গর্ভকালীন সময়ে মেডিটেশন করেন তাদের প্রেশার নরমাল থাকে, অন্যান্য জটিলতাও কম থাকে, সুস্থ প্রাণবন্ত শিশুর জন্ম তারা দেন।
কল্যাণচিন্তা নিরাময়ের ক্ষেত্রেও দারুণ কাজ করে। আসলে বিন যখন ভরে যায় ময়লায়, সেটাকে আমরা যেরকম পরিষ্কার করি, তেমনি মনটাকেও পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আর এজন্যেই প্রয়োজন ধ্যান বা মেডিটেশনের সাহায্য। কারণ, ধ্যানের স্তরে মনের ময়লা, আবর্জনারূপী এই নেতিচিন্তাগুলো পরিষ্কারের কাজ হয় খুব সুন্দরভাবে। আর সেই পরিচ্ছন্ন মনের ফুরফুরে অবস্থায় যখন ইতিবাচক কথা শোনানো হয়, মন-দেহ-আত্মা দারুণভাবে কাজে নেমে পড়ে।
ধ্যানের স্তরে কল্যাণচিন্তা করা, কল্যাণমূলক কথাবলাকে বলো অটোসাজেশন। এভাবে মন যখন স্বনির্দেশ মানে অটোসাজেশনের ভালো ভালো কথা গ্রহণ করার জন্যে পুরোপুরি উপযোগী হয়ে ওঠে অর্থাৎ মনের গ্রহণক্ষমতা সবচেয়ে প্রখর আর শক্তিশালী অবস্থায় পৌঁছায় তখন গভীর নীরবতার মধ্যে আপনি দুমিনিট ধরে নিজেকে বলে যান-আমি এক অজেয় মানুষ। আমার অসাধ্য কিছু নেই। আমি সব পারব। আমি পৃথিবী জয় করব। আসলে মনের সেই প্রশান্ত মুহূর্তে নিজেকে এসব কথা বার বার বলে নিজেকে আপনি পরিণত করেন সত্যিকার এক দুর্জেয় মানুষে। তখন সত্যি সত্যি আপনি পৃথিবী জয় করে বসেন।
মনের এই ধ্যানের স্তর থেকে যখন আমরা সাধারণ জাগ্রত অবস্থায় চলে আসি, তখনো এই ইতিবাচকতার রেশ আমাদের মাঝে অনেকাংশে থেকে যায়। আসলে অবচেতন মন তো ভালো ও মন্দের পার্থক্য করতে পারে না। আবার স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অবচেতন মনটা নেতিবাচক চিন্তাটাই আগে করে ফেলে। একটু আগে যেরকম বলছিলাম যে, রাত ১২টার পরে ফোন এলে আগে আঁতকে উঠি। ঘটনা যা-ই ঘটুক, আগে যেন ইতিবাচক চিন্তাটাই মনে আসে সেজন্যে প্রয়োজন ধ্যান, মেডিটেশন। কারণ, মেডিটেশনের সময়টাতে আমরা মনকে অনেকগুলো ইতিবাচক কথা শোনাই। যেমন ধরুন, আমরা প্রায় প্রতিটি মেডিটেশনে বলি-প্রতিদিন আমি সবদিক দিয়ে ভালো হচ্ছি, লাভবান হচ্ছি, সফল হচ্ছি। নবীজীর (স) শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি বলতে বলার রহস্য এখানেই। আপনি দিনে ২০/৩০/৪০ জনের সাথে দেখা হওয়ার পর যদি একই কথা বলেন, তাহলে ৪০ বার আপনার মস্তিষ্কে এই ভালো থাকার বাণী যাচ্ছে। বার বার একই বাণী যাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে এই ভালো থাকার তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে। ভালো থাকার আকুতি বাড়ছে। নিউরোসায়েন্টিস্টরা দীর্ঘ পরীক্ষায় দেখেছেন, যখনই মস্তিষ্কে নতুন তথ্য যায়, নতুন ডেনড্রাইট অর্থাৎ নিউরোন থেকে নিউরোনে নতুন সংযোগ পথ তৈরি হয়। ক্রমাগত একই তথ্য যেতে থাকলে মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো বদলে যায়। মস্তিষ্ক তখন এই নতুন বাস্তবতা সৃষ্টিতে কাজে নেমে পড়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কল্যাণচিন্তা ধ্যানের স্তরেই করতে হবে কেন, এই কথাগুলো ধ্যানের স্তরেই বলতে হবে কেন? মেডিটেশন করলে বোঝা যায় মনের শান্ত ও শিথিল অবস্থাতেই মন হয়ে ওঠে সবচেয়ে শক্তিশালী। রবীন্দ্রনাথ একবার লিখেছিলেন, উত্তেজনা এবং শক্তি এক নহে। ইহারা পরস্পরবিরোধী। উত্তেজিত মুহূর্তে আমরা সবচেয়ে শক্তিহীন। সমস্যাগ্রস্ত হলে বা বিপদে পড়লে আমরা যদি শান্ত ও যুক্তিপূর্ণ থাকেতে পারি, তখন মনের ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়।
একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। যে মানুষটা দৌড়াচ্ছে তার মাথায় সহসা নতুন আইডিয়া আসতে চায় না। কিন্তু আপনারা লক্ষ করে দেখবেন, দাঁত মাজতে মাজতে অনেক নতুন আইডিয়া মাথায় চলে আসে। এর কারণ কী? কারণ, দাঁত মাজার সময় আমরা থাকি অবসরের মধ্যে। সেই বিপুল অবকাশের মধ্যে থাকায় আমাদের মন অফুরন্তভাবে সৃষ্টিশীল হওয়ার সুযোগ পায়।
ধ্যানের স্তরে আমরা সচেতনভাবে নিজের ও অন্যের জন্যে কল্যাণচিন্তা করারই সুযোগ পাই। এখানে অকল্যাণ চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই। কারো ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ চিন্তা মনে এলেই তাকে ক্ষমা করে দেই। আর যদি সে ক্ষমার অযোগ্য কিছু করে থাকে, তাহলে তার বিচারের ভার পরম করুণাময়ের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আর সকল ধর্মও ধ্যানে-জাগরণে সবসময় সুচিন্তা করার কথা বলে।
বায়হাকি শরীফের হাদীস হচ্ছে, নবীজী (স) বলেন, সে ব্যক্তিই সৎ-যে চিন্তা, কথা ও কাজে সৎ। ঋগবেদে বলা হয়েছে, কর্মব্যস্ত থাকতে। কারণ, অলস মস্তিষ্ক কুচিন্তার সহজ শিকার। ধম্মপদে বলা হয়েছে, চিন্তা বা অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটে স্বভাব বা প্রকৃতিতে। যদি কেউ মন্দ অভিপ্রায় নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে দুঃখ তাকে অনুগমন করে। আর কেউ যদি সুচিন্তা নিয়ে কথা বলে বা কাজ করে সুখ তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। বাইবেলে বলা হয়েছে, দুশ্চিন্তা করে তোমরা জীবনের সাথে কে অতিরিক্ত একটি ঘণ্টাও যোগ করতে পারবে?
ধ্যান সবসময়ই আমাদেরকে কল্যাণচিন্তা করতে শেখায়। রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ দূরের মেডিটেশনে মনের এই ময়লাগুলো দূর করে আমরা যেরকম ভালো ভালো কথা বলি, তেমনি আবার আনন্দের মেডিটেশনে যত যত আনন্দের ঘটনা আছে সব মনে করার চেষ্টা করি। আর শিথিলায়ন যেহেতু মেডিটেশনের মা, এই মেডিটেশনের পুরোটা সময় আমরা আসলে দারুণ এক আনন্দময়তার মধ্যে ডুবে যাই। বরফের চাই বেয়ে পানি গলতে গলতে যেভাবে গড়িয়ে পড়ে প্রশান্তি, আনন্দ আর সুখের স্রোতও আমাদের পুরো অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে যাবে। তখন নিজের এবং অন্যের কল্যাণচিন্তা ছাড়া আর কোনো কিছু মনে আসার সুযোগই পাবে না। এই কল্যাণ, প্রশান্তি আর আনন্দ তখন ছড়িয়ে যাবে আমাদের চারপাশে। পরম করুণাময় আমাদের আরো প্রশান্ত থাকার সুযোগ দিন। প্রশান্তিকে আরো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ দিন।