পরিবার আমাদের আশ্রয়স্থল, ভরসাস্থল। দিন শেষে আগে মানুষ পরিবারে কাছে ফিরে যেত। আর এখন? মানুষ বাসায় ফিরে যায়। বলবেন যে বাসায় যাওয়া মানেই তো পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছি। আসলে কী তাই? বাসায় গেলে কি আমরা পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে যাই? আমরা কার কাছে ফিরে যাই? টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফেসবুক, ভাইবার, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি আরো যত যা কিছু আছে সে-সবের কাছে ফিরে যাই। বস্তু বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ পাওয়ার পর, আমরা আসল প্রাণের হাত ছেড়ে সেগুলোকে হাতের মুঠোয় তুলে নিয়ে পরিবারকে করে দিয়েছি নিষ্প্রাণ নির্জীব। এখন দেখা যায়, একদিকে মা সিরিয়াল দেখছেন, ছোট শিশু ট্যাব নিয়ে বসে কার্টুন দেখছে। বাবা ফেসবুকে, বাসার তরুণ সদস্যটি ঘরের দরজা বন্ধ করে অনলাইনে গেমস খেলছে। অর্থাৎ সবাই যার যার মতো ব্যস্ত স্মার্টফোন ট্যাব বা টিভি নিয়ে। আর বৃদ্ধা মা জেগে বসে থাকেন কখন সন্তান ঘরে ফিরবে, তাকে একনজর দেখে ঘুমাতে যাবেন। কিন্তু তাকে দেয়ার মতো কোনো সময়ই কারো নেই।
কেন পরিবারকে সময় দেয়া গুরুত্বপূর্ণ? এই কেন-র উত্তর অর্থাৎ পরিবারেকে সময় দেয়ার লক্ষ্য যদি আমাদের কাছে পরিষ্কার থাকে তাহলেই আমরা সুখী পরিবার গড়ে তুলতে পারব। আমরা যদি পাশ্চাত্য জীবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তাদের পরিবার বলতে কিছু নাই, সমাজ বলতে কিছু নাই, তাদের আসলে জীবন বলতেই কিছু নাই। পাশ্চাত্যের মানুষরা হচ্ছে অনেকটা বর্ণচোরা, তারা বাইরে সাজগোজ করে থাকে কিন্তু আমরা কেউই জানি না তাদের ভেতরটা কত শূন্য!
কেন তাদের ভেতরটা শূন্য? কারণ পরিবার বিহীন জীবন এখন তাদের সমাজকেও গ্রাস করছে। পরিবার হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি। তাই পরিবারের পরিচর্যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিক ধসের যে কিনারায় পুরো মানব জাতি দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে রক্ষা পেতে হলে ফিরে তাকাতে হবে পরিবারের দিকে। মনোবিজ্ঞানীরা, সমাজবিজ্ঞানীরা এখন একথাই বলছেন।
এখন অধিকাংশ পরিবারেই দেখা যায় মা-বাবা বা স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী। দুজনই সারাদিন বাসার বাইরে থাকেন। তাদের সারাদিনের ব্যস্ততা থাকে ক্যারিয়ার নিয়ে। তারপরের সময়টুকু? বাসায় ফেরার পরের সময়টুকুতে আমরা কী করছি? হয় পুরোটা সময় টিভি দেখছি অথবা সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফালতু আড্ডায়, অপ্রয়োজনীয় কাজে সময় ব্যয় করছি। আর এর ফলে কী হচ্ছে? এখনকার সময়ে কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীদের দেখে আমাদের মনে কি এই প্রশ্ন আসে না যে কেন তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে? কেন তাদের মধ্যে মায়া-মমতা ভালবাসা জন্ম নিচ্ছে না? কেন তারা একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে? কেন তাদের শুধু চাই চাই? কেন তাদের মধ্যে রাগ, জেদ অভিমান এত বেশি? কেন তারা মা-বাবা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? কেন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে? কেন কিশোর বয়সে খুনের মতো ঘটনায় জড়িয়ে যাচ্ছে? কেন তারা অপরাধজগতে হারিয়ে যাচ্ছে? কেন তারা মাদকাসক্ত হচ্ছে? কেন তারা মাদকের মতোই ভয়ংকর নেশা ইন্টারনেট ফেসবুক–এ আসক্ত হচ্ছে? শুধু কিশোর-কিশারী, তরুণ-তরুণী? একই ঘটনা ঘটছে পরিবারের অন্য সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও। দাম্পত্য কলহ বেড়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছে। আর আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে সম্পর্কের প্রতি অবিশ্বস্ততা। বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাছে রাখতে চান না অধিকাংশ সন্তান। তাদের কারো কারো ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এসবই এখনকার বাস্তবতা। কেন? কারণ আমরা এখন বাসায় ফিরে পরিবারে সময় দেই না। আমরা এখন হয় বাসায় ফিরতেই চাই না, নয়তো বাসায় ফিরলে নিজের আলাদা জগতে সময় কাটাই। এসবের কারণ কী?
এর কারণ হতে পারে পরিবারের সদস্যদের সাথে ভুল বোঝাবুঝি। তাদের প্রতি অভিযোগ করি যে, তারা আমাকে বোঝে না। কিন্তু আমরা তাদের কতটুকু বুঝতে চেষ্টা করি? আবার হতে পারে-মমতা অনুভব না করা। মনে হয়, আমারই তো মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী/ স্বামী, সন্তান, আলাদা করে মমতা দেয়ার কী আছে।
তবে সবচেয়ে বড় কারণ কী জানেন? আমাদের স্বার্থপরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা। এমনটি কয়েক দশক আগেও কিন্তু ছিল না। নিজের পরিবার কেন, আমরা প্রতিবেশীর পরিবারেরও খবর রাখতাম, পুরো এলাকাকে যেন মনে হতো একটি পরিবার। তখন বিদ্যুৎ চলে গেলে মায়েরা মায়েরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে গল্প করতেন। ছোটরা ছোটরা আবার রাস্তায় খেলতে শুরু করত। সে সময় সবাই সবাইকে চিনতেন, জানতেন। আর এখন নিজের পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকেন, তিনি কী করেন, সেটাই আমরা জানি না। কেন জানি না? কারণ দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গেছে অনেকটা চাচা, আপনা প্রাণ বাঁচার মতো। নিজেদের গণ্ডি ঠিক করে নিয়েছি আমরা। আর সেই গণ্ডির ভেতরে আমাদের কিছুটা প্রশ্রয় পেয়েই ঢুকে গেছে ভার্চুয়াল জগত। আর এই ভার্চুয়াল জগতই আমাদের সম্পর্কের ভুল বোঝাবুঝি এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি মমতা অনুভব করতে না পারার জন্যে দায়ী। ভার্চুয়াল জগত আমাদের পরিবার থেকে, সমাজ থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আমরা বাসায় ফিরছি কিন্তু পরিবারে সেই আপন মানুষদের কাছে ফিরতে পারছি না। বাসায় ফিরে পরিবারকে সময় না দিয়ে আমরা ফালতু আড্ডায় সময় ব্যয় করছি।
একসময় আড্ডা দেয়ার জন্যে বন্ধুরা সবাই একসাথে হতে হতো। প্রতিবেশীদের নিয়েও জমজমাট আড্ডা হতো। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যেত ফালতু কথায়, ফালতু কাজে। কিন্তু এখন দেখাদেখির কষ্টটুকুও কমে গেছে। এখন হাতের মুঠোর টাচস্ক্রিনে আড্ডা চলে। কখন যে রাত পেরিয়ে দিন হয়, কখন কাজের সময়, ক্লাসের সময় পেরিয়ে যায়, সেদিকেও মন থাকে না। এতে আমরা শুধুই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। দুয়েকটি ঘটনা শেয়ার করি আপনাদের সাথে-
এক মেয়ে লিখেছে, আমার বাবার দিনের ৯৫% সময় কাটে প্রযুক্তির সাথে। বাবা চাকরি করেন। সারাদিন শেষে বাসায় ফিরে কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে পড়েন। ল্যাপটপে নাটক সিনেমা দেখা শেষ হলে, স্মার্টফোন নিয়ে সময় কাটাতে কাটাতে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম থেকে উঠে রাতের খাবার খেয়ে আবার ফোনে সময় কাটাতে কাটাতে ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠেও অফিস যাওয়ার আগ পর্যন্ত মোবাইলই তার সব।
টিভি সিরিয়ালে আসক্ত এক মায়ের কথা বলি, তিনি সিরিয়ালের প্রতি এত মনোযোগী ছিলেন যে, তার পাঁচ বছরের সন্তান যে কখন দুপুরে ঘর থেকে বেরিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে সেই খবর মায়ের নেই। আসলে এভাবে সারাদিন বাসায় থেকেও কি পরিবারকে সময় দেয়া যাচ্ছে? এই সিরিয়াল আসক্তির জন্যে আসলে পরিবারে থেকেও পরিবারে নেই।
ফেসবুকের কল্যাণে এখন প্রেম করে বিয়ে করা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই বিয়ে কতটুকু কল্যাণকর হয়? কতটুকু টিকে থাকে? এক তরুণ-তরুণী ফেসবুকে প্রেম করে বিয়ে করেন। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনই ফেসবুক আসক্ত। দুজনের মধ্যে প্রতিদিন ঝগড়া। কোনো সুখ বা শান্তি নেই তাদের পরিবারে। স্বামী ফেসবুকের কল্যাণে আবার নতুন প্রেমে জড়ান। কিন্তু যার সাথে প্রেম করছেন তাকে জানান নি যে তিনি বিবাহিত। আর স্ত্রীও জানেন না স্বামী কী করছে। শুধু দিন দিন দুজনের দূরত্ব বাড়ছে। স্ত্রী পুরো বিষয় জানার পর তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। আর যার সাথে নতুন প্রেম করেছে, মেয়েটি প্রতারিত হয়েছে এটা জানার পর আত্মহত্যা করেছে। আর সেই তরুণকে মেয়েটির পরিবার আসামী করে মামলা করায়, তরুণটির ঠাঁই হয় কারাগার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তিনটি পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এরকম ঘটনা কিন্তু একটি বা দুটি ঘটছে না। পুরো বিশ্বে এখন এমন ঘটনাই বেশি ঘটছে। আর এর পেছনের মূল কারণ হচ্ছে আমরা পরিবারকে সময় না দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় দিচ্ছি। ফেসবুকের কারণে পরকীয়া এখন মহামারী। দেখা গেছে পরকীয়ায় জড়িয়ে ১৮ বছরের দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি টানছেন, স্বামী সন্তান ফেলে, নয়তো স্ত্রী সন্তান ফেলে চলে যাচ্ছেন অন্য আরেকজনের কাছে।
এখন আমাদের করণীয় কী? আসলে পরিবারকে সুখী করার জন্যে অনেক কিছু করার প্রয়োজন নেই। অনেক অর্থবিত্ত দিয়ে পরিবার সুখী করা যায় না। তাহলে কিন্তু পৃথিবীর সব ধনী মানুষরাই সুখী মানুষ হতেন, আর ধনী দেশগুলোই সুখী দেশ হতো। পরিবারকে সুখী করার জন্যে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে মমতা। আর এই মমতা দিতে হবে মনোযোগ ও সহনশীলতার সাথে।
এখনকার সময়ে স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব বাড়ছে মনোযোগের অভাবে। আর এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখা যাচ্ছে ঘরে ঘরে। নিজেদের মধ্যে মতের অমিল হতে পারে। পছন্দের অমিল হতে পারে। কিন্তু ছোট ছোট বিষয়ে ঝগড়া করবো না। মমতা দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে সবকিছুকে জয় করা যায়। একটু সময় দিতে হবে, তার সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে হবে।
বাসায় ফিরে বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজখবর নিয়মিত নিতে হবে। তাদের কী প্রয়োজন, তাদের সমস্যা, ভালোলাগা–সবকিছু সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ছুটির দিনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে। অথবা বাসায় সবাই মিলে পিকনিক করতে পারি যে, আজ আমরা সবাই মিলে রান্না করব। প্রতিদিন একবেলার খাবার আমরা একসাথে খেতেই পারি। ছোটদেরকে বলতে পারি টেবিলে খাবার দেয়া এবং গুছিয়ে তোলায় সহযোগিতা করতে। সবাই মিলে গল্প করা, খেলাধুলা করা যেতে পারে।
সন্তানদের নিয়মিত খোঁজ নিতে হবে। এখনকার সময়ে মা-বাবারা সন্তানদেরকে সময় না দিয়ে অনেক দামি উপহার কিনে দেন। সন্তান না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যায়। কিন্তু বস্তু কখনো মমতার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। আমাদের সন্তানের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে হবে, হোক না তা খুব ছোট্ট কোনো বিষয়। আজ যদি আমরা তাদের কথায় মনোযোগ না দেই, অনেক বড় বিষয়, অনেক বড় ঘটনা বা দুর্ঘটনা তারা আমাদের বলবে না। বলার জন্যে বাইরের কাউকে খুঁজে নেবে। যা তার অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ বাইরের বন্ধু ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
খুব ছোট বয়স থেকেই আমরা যদি সন্তানের বন্ধু হই, সময় আর মনোযোগ দেই, তাহলেই আমাদের আর এ অভিযোগ থাকবে না যে সন্তানকে বুঝতে পারি না। সময় ও মনোযোগ দিলে সন্তানের ভেতরের সবকিছু আমরা দেখতে পারব যে, সে কোনো সমস্যায় পড়েছে কিনা, কোনো কষ্টে আছে কিনা, কিসে তার আনন্দ। আর সময় না দিলে কী হবে? একটি ঘটনা শেয়ার করি-
১৩ বছরের কিশোর আত্মহত্যা করার আগে একটি নোট রেখে গিয়েছিল। তাতে সে তার স্কুলের একজন শিক্ষক এবং তার তিন সহপাঠীর নাম বলেছে যে, গত একমাস ধরে তারা শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে আসছিল। অসুস্থতার কারণে ছেলেটি দুই সপ্তাহ ক্লাসে যেতে পারে নি। সুস্থ হয়ে স্কুলে গেলেও ক্লাসে ঠিকমতো পড়া দিতে পারছিল না বলে শিক্ষক যখন তাকে মারধর করেছে, বকা দিয়েছে, তার তিন সহপাঠী তখন হাসাহাসি করেছে, মজা করেছে। দিনের পর দিন এই পরিস্থিতি সে মেনে নিতে পারে নি। তাই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। মা-বাবা কান্নাকাটি করেছেন। সেইসাথে অবাক হয়ে নিজেদেরকে প্রশ্ন করেছেন, একমাস ধরে সে এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে গেল, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না! কেন পারেন নি? কারণ সন্তানের প্রতি সময়, মনোযোগ কোনোটাই দেয়া হয় নি।
স্বামী-স্ত্রী সন্তান এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে সময় দেয়ার জন্যে এখন সবচেয়ে বেশি যা করণীয় তা হচ্ছে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করা। পারলে পুরোপুরি বন্ধ করা। কারণ এই যন্ত্রগুলো মানুষের সময়, সম্পর্ক, নৈতিকতা মূল্যবোধ সবই নষ্ট করে দিচ্ছে। এই প্রযুক্তিপণ্যের নির্মাতারা নিজেরা কিন্তু এসব পণ্য আমাদের মতো করে ব্যবহার করেন না। তারা তাদের কম্পিউটারে, মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইটগুলো ব্লক করে রাখেন। মোবাইল দিয়ে যাতে কোনো অ্যাপ ডাউনলোড পর্যন্ত করতে না পারেন সেই প্রোগ্রামও তারা প্রোগ্রামার দিয়ে তাদের মোবাইলে সেট করিয়ে নেন। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ কিন্তু তার ফেসবুক পেজ নিজে পরিচালনা করেন না। তার একাউন্ট দেখাশোনার জন্যে রয়েছেন ১২ জন এসিসট্যান্ট। কেন তারা ব্যবহার করেন না? কারণ এগুলো শুধুই সময়ের অপচয়। এমনকি তারা তাদের সন্তানদেরও ব্যবহার করতে দেন না এসব যন্ত্র। অথচ আমরা কত অবলীলায় আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছি!
এখন সময় এসেছে সচেতন হওয়ার। আমরা কেন ছোট্ট শিশুদের হাতে তুলে দেবো এই ক্ষতিকর যন্ত্র? আমাদের সন্তানদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে স্মার্টফোন দেবো না। কারণ এটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করছে। আমাদের মূল্যবান সময় কেড়ে নিচ্ছে। তাই এ যন্ত্র এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোকে সরিয়ে রেখে পরিবারে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করবো। কথা বলবো। আলোচনা করবো। পরিবারের সমস্যা, সুবিধা-অসুবিধাগুলো সন্তানের সাথে শেয়ার করবো। পরিবারের কাজে তাকেও অংশীদার করবো তাতে সে পরিবারের অংশ হিসেবে বেড়ে উঠবে।
আমরা কর্মব্যস্ত দিনের শেষে বাসায় ফিরি শান্তির জন্যে। তাই বাসায় ঢোকার সময়ই প্রভুকে স্মরণ করবো। মনে মনে কলবো-বাসায় যাচ্ছি শান্তির জন্যে। আর ঢোকার সময় যিনি দরজা খুলছেন তাকে হাসিমুখে সালাম দিব। বাসায় ঢোকার পর অন্য সবার দরজা খোলা থাকলে, যে কয়জন আছেন সবাইকে সালাম দিব। কারণ সলামের অর্থই হচ্ছে আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। বাসায় ঢুকেই যখন আমরা পরস্পরের শান্তি কামনা করব তখন পরিবারে শান্তির পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
তবে একটি বিষয়, সেটা খুব ছোট্ট, কিন্তু এ ব্যাপারে সচেতন হলে পরিবারে শান্তি আরো বেড়ে যাবে। আর তা হচ্ছে অনেক সময় বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, বেল দিচ্ছি কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না। এ সময় অস্থির হওয়া যাবে না। দরজা খুলতে দেরি হলে অনেকবার কলিংবেল টিপব না। মেজাজ খারাপ করব না। এত দেরি করলে কেন জিজ্ঞেস করব না। এই ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলোতে আমাদের সহনশীলতা পরিবারে শান্তির পরিমাণ বাড়াবে। আর এই সব বিষয়ে আমরা তখনই সহনশীল হওয়ার জন্যে নিয়মিত ধ্যান বা মেডিটেশন খুবই ফলপ্রসু একটি প্রক্রিয়া।
নিয়মিত মেডিটেশন অনুশীলকারীদের অনুভূতি এটাই যে তাদের সহনশীলতা বেড়েছে। যারা পরিবারে সদস্যদের সাথে খুব রি-একটিভ আচরণ করতেন, কারো কথা শুনতে পারতেন না, কিন্তু এখন যে-কোনো পরিস্থিতিতে চুপ করে শুনতে পারেন। অবস্থা বুঝতে পারেন। আসলে মেডিটেশনে আমাদের মনের সংবেদনশীলতা বাড়ে। মমতা বাড়ে। কৃতজ্ঞতা বাড়ে। আমাদের জীবনে পরিবার-পরিজনের কী অবদান তা আমরা বুঝতে শুরু করি। আমরা তাদের সাথে নমনীয় হয়ে কথা বলতে পারি। বাসায় ফিরে তাদের খোঁজ নিতে পারি। কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল সৃষ্টি না করে সেতু নির্মাণ করতে পারি।
পরিবারকে সুখী করতে, আলোকিত করতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবারকে সময় দেয়া। এর কোনো বিকল্প নেই। আমরা করতে হবে সম্পর্ক উন্নয়নের চর্চা। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করব পরিবারের প্রতি মনোযোগী হতে। সকল ব্যস্ততার মধ্যেও পরিবারেকে কোয়ালিটি সময় দিতে হবে। এই সময় দেয়া আসলে সময়কে বিনিয়োগ করার সুফল বয়ে আনবে। পারিবারিক সুখশান্তি আমাদের একান্ত চাওয়া। ঘরে ফিরে যেন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তানদের হাসিমুখ দেখতে পাই। এমন একটি সুখী, প্রশান্তিময় পরিবার নির্মাণে পরিবারে সবার ভূমিকা রয়েছে, রয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই পরিবারই আমাদের সবকিছু। আমাদের বিপদে, দুঃখে, দুঃসময়ে, আনন্দে, সাফল্যে তারাই আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। আমরা পরিবারকে ভালবাসব। মমতার বন্ধন তৈরি করব। পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করব। পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত হবো। সবাই মিলেমিশে পরিবারকে আনন্দের ভুবন হিসেবে গড়ে তুলব। পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে এই তৌফিক দান করুন।
খুব সুন্দর