সেলফি নিয়ে আলোচনার শুরুতে আমাদের সবারই জানা একটি চরিত্র আলোকপাত করা যাক। মি. বিন। এই কমেডি সিরিজের নাম শুনি নি, এমন মানুষ খুব কম আছেন। মি. বিনের একটি পর্ব ছিল এরকম-মি. বিন বেড়াতে গেছেন পার্কে। চারপাশের সবকিছু তাকে মুগ্ধ করছে। আমরাও এরকম প্রাকৃতিক দৃশ্যে মুগ্ধ হলে বলি যে, ছবি তোলো। তারও মনে হলো ছবি তুলি। কিন্তু কে তুলে দেবেন। তিনি যে একাই এসেছেন। তাই পার্কে ঘুরতে আসা আরেক যুবককে মি. বিন অনুরোধ করলেন ছবি তুলে দিতে। যুবকটিও রাজি। কিন্তু তার মনে তো অন্য চিন্তা। সে মি. বিনকে বলছে ঘুরে দাঁড়ান মানে আমার দিকে পিঠ দিয়ে সামনে এগুতে থাকেন। মি. বিন এগোন। যুবকটি বলে আরো এগুতে হবে। আবার মি. বিন এগোন। এভাবে যখন যুবকটি থেকে মি. বিন বেশ দূরে সরে এলেন এবং তখনো যুবকটির দিকে পিঠ দেয়া অবস্থায় দাঁড়িয়ে, অনেকক্ষণ আর কোনো কথা নেই। মি. বিন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখেন যুবক নাই। তার প্রিয় ক্যামেরা নিয়ে লাপাত্তা।
সম্প্রতি এক কিশোর যে প্রতিনিধিত্ব করছে ইদানীংকার সেলফি প্রজন্মের, সে এই পর্বটি দেখে বলছে-মি. বিনের সময় সেলফি ছিল না। তাই নিজের দামি ক্যামেরা এভাবে খোয়াতে হলো। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। হাতে মোবাইল ক্যামেরা রেখে সেলফি তুলি। হাত যদি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির মতো লম্বা না হয়, তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই। হাতে আছে সেলফি স্টিক। কিছুদিন পরে হয়তো বেরুবে লেগফি স্টিক! পায়ের পাতায় স্টিক ধরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছবি তোলার জন্যে। নিজের ক্যামেরা/ মোবাইল সেট বাঁচাতে গিয়ে আমরা কিন্তু নিজেদেরকে বাঁচাতে পারছি না সেলফিটিস বা সেলফি সিনড্রোম রোগ থেকে। যে রোগ আসলে বাড়ায় হতাশা, করে তোলে আত্মকেন্দ্রিক।
সারা বিশ্ব আজ যেন সেলফি জ্বরে আক্রান্ত। সেলফি আসলে কী? নিজের প্রতিকৃতির ইংরেজি হচ্ছে সেলফি। ‘সেলফি’কে অক্সফোর্ড অভিধান সংজ্ঞায়িত করেছে-একটি ছবি (আলোকচিত্র) যা নিজেরই তোলা নিজের প্রতিকৃতি, সাধারণত স্মার্টফোন বা ওয়েব ক্যামে ধারণ করা এবং তা যে-কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপলোড (তুলে দেয়া) করা। সারা বিশ্বে সবাই কেন ছবি তুলছে এবং কেন তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছে? এক সাহেবের গল্প বলি তাহলে আমরা কিছুটা ধারণা পাব-
একবার একজন সাহেবের মাথায় অদ্ভুত ধরনের খেয়াল চেপে বসল। রামা, শ্যামা, যদু, মদু সবাই নাম করে ফেলছে আর তিনি কিনতে পারছেন না? কী হবে তবে বেঁচে থেকে? এরচেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তো তিনি কী করবেন? সাহেবের বাড়ির সামনের দিকে ছিল বিরাট উঁচু একটা পাইন গাছ। সাহেব তাতে তর তর করে উঠে পড়লেন। সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনি আত্মহত্যা করবেন। কিন্তু সাহেবের স্ত্রী তার এই কাণ্ড দেখে থ! নিচ থেকে স্ত্রী ডাকাডাকি শুরু করলেন, অনুনয় বিনয় করলেন নিচে নেমে আসার জন্যে। অনেক অনুরোধ করেও যখন হলো না তখন তো স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করলেন। বলতে লাগলেন, তোমরা কে আছো দেখো গো আমার স্বামী সুইসাইড করছে।
মহিলার চিৎকার, কান্নাকাটিতে আশপাশের ছেলে জোয়ান বুড়ো সবাই এসে হাজির। তারা এসে সেই সাহেবকে অনেকভাবে নামানোর চেষ্টা করল। কেউ বলে, বাঁশ দিয়ে খোঁচা দাও তরতর করে নেমে আসবে। কেউ বলে, নিচে শুকনো ডালপালা জড়ো করে রেখে ধোঁয়া লাগাও, চোখ জ্বালা করলে আর গাছে চড়ে থাকতে পারবে না। কেউ বলে, ওর পা ধরে টেনে নামাও। এমনি সব জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু কোনোভাবেই সাহেব নামবে না। অনেকে অনেকভাবে চেষ্টা করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহেবেরই জয় হয়। সন্ধ্যা নেমে আসলে বিরক্তি নিয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু স্ত্রী তো নাছোড়বান্দা, স্ত্রী আবার বোঝাতে থাকে। বলে যে, আমি কী অন্যায় করলাম তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? সাহেব বলেন, তুমি অন্যায় করতে যাবে কেন? আমি ভেবে দেখলাম যদি নামই না কিনতে পারি তবে কী হবে বেঁচে থেকে? তাই বলছি বিরক্ত করো না আমায়, মরতে দাও।
সাহেব অনেকবার চেষ্টা করল গাছের মগডাল থেকে লাফিয়ে পড়ার জন্যে। কিন্তু নিচের দিকে তাকালেই তার মাথা ঘুরে যায়। তাই তিনি আর লাফ দিতে পারেন না। এমনি করে গাছের মগডালে বসে থাকতে থাকতে একদিন গেল, দু দিন গেল, দেখতে দেখতে প্রায় একমাসই পেরিয়ে গেল। আরো কিছুদিন যেতে না যেতে দু-চার জন করে অনেক লোক তাকে দেখার জন্যে জড়ো হতে শুরু করল। সবার মুখেই সাহেবের গল্প। সাহেব কেন গাছে উঠে বসে আছে, কেন তার এই ধরনের খেয়াল চাপল এ নিয়ে গানও বেঁধে বসল কয়েকজন। কেউ বইও লিখে ফেলল। সাংবাদিকরাও খবর পেয়ে ছুটে এলেন। ছবি তোলা শুরু হলো। বড় বড় হরফে সাহেবের নাম আর ছবি তারা ছেপে দিল কাগজে কাগজে। হুজুগে কিনা হয়! সাহেব দেখলেন বেশ মজা তো! এত সস্তায় যে নাম হয়ে যায় তা তার ধারণায় ছিল না। নাম যখন সত্যি সত্যি ছড়িয়ে পড়ল, তখন আর আত্মহত্যা করে কী হবে? সাহেব বুক ফুলিয়ে নেমে পড়লেন গাছ থেকে।
এখন আমাদের চারপাশেও কিন্তু এমন সাহেব বা মেমসাহেবের অভাব নেই। সবাই এখন সস্তায় নাম কিনতে ব্যস্ত। আর এই সস্তায় নাম কেনার জন্যে অনেকেই সেলফি তুলছে। আর সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়া-ফেসবুক টুইটার ইনস্টাগ্রাম প্রভৃতি আরো যত যোগাযোগ মাধ্যম আছে তাতে আপলোড করছে মাত্র কয়েক মিনিটে। কেন করছে? শুধু নিজেকে প্রকাশ করার জন্যে। চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, উইকিপিডিয়া বলছে, সেলফি শব্দটি এসেছে সেলফিশ থেকে। না বুঝে যেভাবেই এতে আমরা অভ্যস্ত হই না কেন এটা আমাদের মনোজগতকে কিন্তু ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে চলেছে। কারণ এতে আমরা মাত্রাতিরিক্ত আত্মকেন্দ্রিকতায় বুদ হয়ে পড়ছি। অযথা সেলফি তোলা মানুষগুলো অকারণে নিজের বা বন্ধুদের একত্রে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে শান্তি পায়। আর ততক্ষণ অবধি মানসিক অশান্তিতে ভোগে যতক্ষণ অবধি তা পোস্ট করতে না পারে!
এই আত্মকেন্দ্রিকতা কতটা বিপদজনক?
হাতের স্মার্টফোন দিয়ে বিপদজনক কায়দায় নিজের ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে তরুণ-তরুণীরা তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে ব্শ্বিজুড়ে আলোচনায় আসার বাসনায় এখন মৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে দ্বিধা করছে না। কেমন সেলফি তুলছে তারা? একজন উন্মত্ত ষাঁড়ের সঙ্গে সেলফি তুলছে, কেউ তুলছে সিংহের সঙ্গে, কেউ গাড়ি চালানোর সময়, কেউ আবার এগিয়ে আসা ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ছবি তুলছে। মস্কো ব্রিজ থেকে ঝুলন্ত সেলফি তুলতে গিয়ে অকালে মারা পড়ে রাশিয়ার এক যুবক। রাশিয়াতেই ১৭ বছরের এক কিশোর ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে ‘ইনস্টাগ্রামে’ সেলফি পোস্ট করতে গিয়ে নিচে পড়ে মারা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিক সেলফি তোলার সময় অসাবধানতাবশত নিজের ঘাড়ে গুলি চালিয়ে প্রাণ দিয়েছে। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মও কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণভাবে সেলফি তুলে নিজের জীবন বিপন্ন করছে। ২০১৭ সালে পিরোজপুরে ভাঙা ব্রিজে সেলফি তুলতে গিয়ে ২০ জন আহত হয়েছে। ঈদযাত্রায় খুলনাগামী ট্রেনের ছাদে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রায় ৫০ জন যাত্রী ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়। সেলফির কারণে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে ভারতে। কার্নেগী মেলোন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দেখা যায় ২০১৪-১৫ সালে বিশ্বজুড়ে ১২৭টি সেলফি সংক্রান্ত মৃত্যুর ৭৬টিই হয়েছে ভারতে।
এ কেমন সেলফি বাতিক! জীবনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে হলেও সেলফি তুলতে হবে? এমন আসক্তি কি মানসিক বিকৃতির লক্ষণ নয়? নিজেকে জাহির করার জন্যেই এই উন্মাদনা। যোগাযোগ মাধ্যমে যখন দেখছে যে অমুক তার একটা ছবি পোস্ট করে এত লাইক, এত কমেন্ট পেয়েছে আর সে কিছু করতে পারছে না, তার কোনো নাম নেই। তখন সে-ও তার সেলফি তুলছে এবং যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে রাতারাতি নামি-দামি মানুষ হতে চাইছে। আর যোগাযোগ মাধ্যমে আরো মানুষ যখন এ ছবি দেখেন তখন তারা মনে করেন তাদের তোলা ছবিও মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে; নিয়ে যেতে পারে খ্যাতির চূড়ায়!
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সেলফি তোলা এবং ধারাবাহিকভাবে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে যাওয়ার এই প্রবণতাকে ‘মানসিক অসুস্থতা’র লক্ষণ বলে মনে করছেন। ১০০ জনের ওপর চালানো এক জরিপের ফলাফল দেখিয়ে এই গবেষক দলের প্রধান জেস ফক্স বলেন, সেলফি পোস্ট করাকে অনেকেই ‘ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় রূপের প্রকাশ’ বলে মনে করেন। সেলফি যত বিপদজনক, তত বেশি লাইক ও শেয়ার পাওয়ার লোভও তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনও (এপিএ) সম্প্রতি মানসিক ব্যাধির সঙ্গে সেলফি তোলার সম্পর্কের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শিকাগোতে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক পরিচালনা পর্ষদের সভায় সেলফির সঙ্গে মানসিক ব্যাধির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। গবেষকেরা দাবি করেছেন, অতিরিক্ত নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে দেয়ার এই মানসিক সমস্যার নাম ‘সেলফিটিস’।
যারা নিয়মিত সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট দেয়ার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছেন, তাদের আচরণে বেশ প্রবলভাবে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হয়েছে, আর সেটি হচ্ছে-‘নার্সিসাস’। আত্মপ্রেমিক বা আত্মকেন্দ্রিক মানুষদের আমরা সাধারণত নারসিসিস্ট বলি। এ নিয়ে পৌরাণিক গল্প আছে-নার্সিসাস নামের এক ব্যক্তি শিকারের পেছনে ছুটে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে এক ঝর্নার কাছে যায়। পানিতে নিজের প্রতিকৃতি দেখে এমনই সম্মোহিত হলেন যে, ওখানেই পড়ে রইলেন। তিনি বুঝতেই পারলেন না যে এটা তার নিজেরই চেহারা। একসময় ওখানেই ডুবে মরলেন। পুরানের এই ঘটনা থেকেই ইংরেজি নার্সিসিজম শব্দের জন্ম। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় যারা ফেসবুকে সেলফি আপলোড করেন তারাও এক ধরনের নার্সিসিস্ট।
কীভাবে আত্মকেন্দ্রিকতা ও হতাশা বাড়াচ্ছে?
আমরা যখন ছবি তুলছি নিজের একই ছবি বার বার তুলছি। একবারে তো আর সুন্দর ছবি আসে না। কয়েকটা তুলতে হয়। যদি একটা ছবি সুন্দর আসে সেখানে কী শেষ হয়? এরপরে মনে হয় এরচেয়ে সুন্দর ছবি তোলা যায় কিনা? বার বার ছবি তুলতে তুলতে নিজের চেহারার খুঁতগুলো একে একে আমাদের কাছে ধরা পড়তে শুরু করে। বাস্তবে বোঝা না গেলেও ক্যামেরাতে অনেক বেশি খুঁতগুলো বোঝা যায়। যখনি নিজের খুঁতগুলো আমাদের সামনে উঠে আসে আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হতে থাকে। আমার চেহারাটাকে ঠিক করতে হবে, আমার ফিগারটাকে ঠিক করতে হবে। এরপরে শুরু হয় ডায়েট কন্ট্রোল। জেন্টস পার্লার/ বিউটিশিয়ানের কাছে গিয়ে ঘষামাজা করা। মুখে বিভিন্ন প্রোডাক্ট লাগানো। যত একজন মানুষ নিজেকে পারফেক্ট করতে চেষ্টা করে, যত পারফেক্ট ছবি তুলতে চেষ্টা করে তত তার মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে। অবশেষে আত্মআসক্তি রোগে তাকে আক্রান্ত হতে হয়। আর সেটা আত্মহননের পথেও নিয়ে যেতে পারে। ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের থিয়াগারাজার স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট যৌথভাবে এ নিয়ে একটি জরিপ করেছে-
ইংল্যান্ডের এসেক্সে থাকেন ২২ বছরের জুনায়েদ। প্রতিদিন নিজের ২০০টা সেলফি তোলেন। ইনস্টাগ্রামে তার ফলোয়ার আছে ৫০ হাজার। সেলফি পোস্ট করার সময়টা খুব ভেবেচিন্তে ঠিক করেন জুনায়েদ যাতে যত বেশি সম্ভব ‘লাইক’ পাওয়া যায়। কোনো সেলফি যদি ৬০০-র কম লাইক পায় তাহলে তিনি ছবিটি মুছে ফেলেন।
জুনায়েদ সেলফির জন্যে নিজের চেহারা ‘আপগ্রেড’ করিয়েছেন, দাঁত সাদা করেছেন, চিবুক, চোয়াল, ঠোঁট ও গাল ভরাট করেছেন, চোখ এবং চুলে বটক্স ইনজেকশন নিয়েছেন যাতে চামড়ার কুঁচকানো ভাব কেটে যায়, ভ্রু-তে ট্যাটু করিয়েছেন, আর জিম করে রোগা হয়েছেন।
আরেকজন ড্যানি বোম্যান। বয়স ২৩। ক্রমাগত সেলফি তোলার জন্যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বহুবার দিনে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাটিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রত্যেকটা ছবিতেই নিজের কোনো না কোনো ত্রুটি খুঁজে পেতেন। একপর্যায়ে সেলফির নেশায় গুরুতর মানসিক সমস্যায় পড়েন। কমতে থাকে ওজন। কাঙ্ক্ষিত মানের সেলফি তুলতে না পারায় বাড়তে থাকে হতাশা। একপর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও চালান ড্যানি। শেষ পর্যন্ত রিহ্যাবে যেতে হয় তাকে।
২০১৭ সালে রয়াল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ একটি জরিপ চালায় ১১ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর। সেখানে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনম্মন্যতা এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছে, ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের চেহারা নিয়ে মন খারাপ হয়েছে। জরিপকৃতদের অর্ধেকই বলেছেন, ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও অশান্তি বেড়ে গেছে। দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বলেছেন, ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান-হয়রানি করার প্রবণতা আরো গুরুতর আকার নিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত সেলফি তোলাকে ক্ষতিকর কিছু মনে না হলেও, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে গুরুতর। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে যেমন এর প্রমাণ মিলেছে, তেমনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও অতিরিক্ত সেলফি তোলার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। ডিআইওয়াই হেলথ একাডেমি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেলফি তোলার সঙ্গে আত্মমগ্নতা বা আত্মমুগ্ধতার সম্পর্ক রয়েছে। নিখুঁত সেলফি তোলার জন্যে বার বার চেষ্টা করতে গিয়ে তা একসময় নেশায় পরিণত হয়। আবার নিজের নিখুঁত ছবিটি তুলতে না পারার ব্যর্থতা অযাচিত হতাশার জন্ম দেয়।
কোন দর্শণীয় স্থানে বেড়াতে গেলে সেলফি তোলা, ভালো কোন রেষ্টুরেন্টে খেতে গেলে সেলফি তোলা, মার্কেটে শপিং-এ গেলে সেলফি তোলা, দেশ-বিদেশে ঘুরতে গেলে সেলফি তোলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারপর সেই সেলফিগুলো যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করা হয়; সেখানে কাঙ্খিত পরিমাণ লাইক পাওয়া-না পাওয়ার উপর অন্যের কাছে নিজের গুরুত্বকে বুঝার চেষ্টা করি। অর্থাৎ প্রাপ্ত লাইক-ডিসলাইকই হয়ে যায় অন্যের কাছে আমি কতকটা গুরুত্বপূর্ণ তার মানদন্ড। প্রাপ্ত লাইকই যেন আমার প্রাইস ট্যাগ। পণ্যের মতো আমার মূল্য প্রদর্শন করে।
আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন বন্ধুদের পোষ্টকরা চটকদ্বার সেলফিগুলো দেখি তখন হতাশায় ভুগি। হয়তো কোন বাল্যবন্ধু নেপালে বেড়াতে গিয়ে সেখানেতোলা কোন সেলফি পোষ্ট করলেন, হয়তো স্কুল জীবনের কোন ক্লাসমেট ফাইভ ষ্টার হেটেলে খাওয়ার সেলফি পোষ্ট করলেন, হয়তো কোন প্রতিবেশী প্রভাবশালী কোন রাজনৈতিক নেতার সাথে সেলফি তুলে পোষ্ট করলেন, তখন নিজের ভেতরটা কেমন যেন চুপসে যায়। হতাশায় নিমজ্জিত হই এই ভেবে যে, আমার বন্ধুরা প্লেনে করে নেপালে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ফাইভ ষ্টার হোটেলে খেয়ে বেড়াচ্ছে, প্রভাবশালীদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটাচ্ছে, আর আমি? আমি কী করছি? আমার অবস্থান কী? আমার জীবন অর্থহীন। ডুবে যাই হতাশায়।
আমাদের করণীয়
দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, ইতিবাচক ভাবনা, নিয়মিত মেডিটেশন, সৎকর্মে ব্যস্ত থাকা আর জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা এই আত্মকেন্দ্রীকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। নিজেকে আত্মআসক্তি থেকে বের করে আনতে হলে আমাদের আত্মনিমগ্ন হতে হবে। যখন আমরা আত্মনিমগ্ন হবো তখন উপলব্ধি করব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যের কাছে নিজেকে জাহির করার এমন আত্মবিধ্বংসী প্রচেষ্টা অর্থহীন। আমরা আমাদের আত্মপরিচয় ভুলে গেছি সেই ব্যাঘ্র শাবকের মতো, যে কিনা ভেড়ার পালের সাথে থাকতে থাকতে নিজেও ভেড়ার মতো আচরণ করতে শুরু করে।
আমাদের বুঝতে হবে সেলফি আনন্দ বা বিনোদনের উপলক্ষ হলেও ধীরে ধীরে তা ব্যবহারকারীর মনোজগতে পরিবর্তন ঘটায় অনেকটা মাদকের মতো। ফ্যান্টাসিতে যার শুরু, ধ্বংসে যার শেষ! আত্মপ্রচার আর প্রসারের সর্বনাশা খেলায় নিজেকে জড়িয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্ম মানসিক অস্থিরতার শিকার হোক, প্রযুক্তি মাফিয়াদের শিকার হোক নিশ্চয়ই এটা আমাদের কারো কাম্য নয়। তাই এখন প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মকে এই মরণ নেশা থেকে মুক্ত রাখতে সম্মিলিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করা।
আসলে এই সেলফি রোগ থেকে মুক্ত হতে হলে প্রথমে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ আমরা সেলফি তুলিই মূলত ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম জাতীয় সামাজিক মাধ্যমে দেবার জন্যে। আমরা আমাদের স্মার্টফোন থেকে ফেসবুক অ্যাপ ডিলিট করে ফেলব। সন্তানের বয়স ১৮ হবার আগে তার হাতে স্মার্টফোন তুলে দেব না। প্রয়োজন হলে অন্যের ছবি তুলব, সেলফি নয়। কেউ একসাথে সেলফি তুলতে চাইলে বিনয়ের সাথে বলব যে, আসুন আমরা দাঁড়াই আর তখন বুঝেশুনে তৃতীয় কাউকে অনুরোধ করব যেন তিনি ছবি তুলে দেন।
সেলফি রোগ থেকে বাঁচার জন্যে আমাদের ভালো কাজে ব্যস্ততা বাড়াতে হবে। সেবামূলক কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। কবি কামিনী রায়-এর ‘সুখ’ কবিতার কয়েকটি লাইন হচ্ছে-
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে
আসলে এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই চিরস্থায়ী নয়। মানুষ কেবল চিরস্থায়ী থাকতে পারেন তার মহৎ কর্মের মাধ্যমে। কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে দীর্ঘ সময়। যারা শুধু নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পান না। জীবনে কেউ যদি ভালো কাজ না করেন তবে সে জীবন অর্থহীন। আর অন্যের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করার মধ্যেই আত্মা প্রকৃত অর্থে সুখী হয়। মানুষ সুখের জন্যে দিশেহারা, আর এই সুখ পাওয়া যায় কাজের মধ্যে ডুবে থেকে। মানুষের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতাই পারে মানুষকে মহৎ করতে। মাদার তেরেসা কলকাতায় এসে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের ২৭টি বছর, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধী, হাজী মোহাম্মদ মহসিন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। বিশ্বের যা কিছু মহান, মহৎ কর্ম, যা মানব সভ্যতাকে স্বর্ণ শিখরে নিয়ে গেছে তার মূলে রয়েছে সেবামূলক কাজ, তারা কেউ সেলফি তুলে খ্যাতিমান হন নি। বরং যারা খ্যাতিমান হয়েছেন, অন্যরা তাদের ছবি তুলেছেন। একটি মজার তথ্য দিয়ে আলোচনা শেষ করছি-ব্রিটেনের লিনিয়া স্কিন ক্লিনিকের মেডিকেল ডিরেক্টর সাইমন জোয়াকি বলেন, অতিরিক্ত সেলফি ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করে। তীব্র লাইট আর স্মার্টফোনের রেডিয়েশনে মুখে বলিরেখা দেখা দেয়। এতে অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ফোনের স্ক্রিন থেকে যে নীল আলো বের হয়, তা আমাদের ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করে।’ তাই তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যেতে না চাইলে সেলফি ‘পাগলামি’ থেকে বেরিয়ে আসারই পরামর্শ দিচ্ছেন ডাক্তাররা। যে-ই চেহারাকে দর্শনীয় করার জন্যে আমরা সেলফি তুলছি তা যদি আমাদের চেহারারই ক্ষতি করে তা কিন্তু আমাদের হতাশা আর বিষণ্ণতার পরিমাণ ক্রমাগত বাড়াবে। তাই সেলফি-কে ‘না বলুন’। অন্যদেরও সচেতন করুন এই ভাইরাস সম্পর্কে।