আত্মিক সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি কিছু। একটু খেয়াল করলে দেখব, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মেজ আপার সাথে হয়তো আমাদের বনে ভালো। কিংবা ছোড়দার (দাদা/ ভাইদের মধ্যে ছোট যিনি) সাথে সব শেয়ার করতে ইচ্ছে করে। তাদের প্রতি রক্তের টান যেমন রয়েছে, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে আত্মার টান। আবার দেখব যে, ক্লাসের সেই সহপাঠীই আমাদের বন্ধু হয়েছে, যার সাথে বসতে, কথা বলতে, একসাথে হাঁটতে আমাদের ভালো লাগে। এই বন্ধুটির সাথে তো কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। তারপরও কেন এত ভালোলাগা। কারণ আত্মিক সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি কিছু। আর এই আত্মিক টান রয়েছে যে যে সম্পর্কগুলোর মাঝে, সে সম্পর্কগুলোই আমাদেরকে প্রেরণা দেয়, উৎসাহিত করে। বিপদে পাশে থাকে, সাহস যোগায় মনে। আসলে এগিয়ে চলার জন্যে, ঘুরে দাঁড়াবার জন্যে সবচেয়ে বড় যে শক্তি-মমতা তা আমরা পাই আত্মিক সম্পর্কগুলোর কাছ থেকেই।
আজকে আমরা আলোচনা শুরু করতে চাই একটি গল্প দিয়ে। এটি একটি সচেতনতামূলক টিভি বিজ্ঞাপনের গল্প। গল্পটিতে দেখায়-স্বামী ও স্ত্রী প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা করছেন। ওদিকে তাদের ছয়/ সাত বছরের ছোট্ট মেয়েটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কয়েকদিনের মধ্যেই মা-বাবা দুজন দুজায়গায়। আর মেয়েটির ঠাঁই হলো নানা-নানির কাছে। রাতে একা বিছানায় কোলবালিশ ধরে কাঁদে আর বলে আমার আম্মুকে এনে দাও, আমার আব্বুকে এনে দাও।
একদিন নানি তাকে খাওয়াতে চাচ্ছেন, কত বাহানা করে বলছেন যে, তুমি না চিকেন পছন্দ করো, নাও খাও। সে খাবে না, তার যে কিছুই ভালো লাগছে না। নানি নানাকে বললেন-কী করি বলো তো? নানাভাই বললেন, চলো তোমাকে দোকান থেকে ঘুরিয়ে আনি। তুমি যা চাও সব সেখানে আছে। মেয়েটি খুশি হয়ে গেল। সত্যি! আমি যা চাই সব আছে দোকানে! নানা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, সব আছে। ঠিক আছে নানাভাই, আমি এক্ষুণি তৈরি হয়ে আসছি। নতুন জামা পড়ল, মিনিব্যাগ একটা নিল, পেন্সিল বক্সের ভেতর থেকে কিছু টাকা বের করে সেটাও ব্যাগে রাখল। তারপর নানার সাথে একটি দোকানে ঢুকে সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করছে, আপনাদের এখানে আদর আছে? সেলসম্যান প্রথমে বোঝেন নি। কী লাগবে খুকি তোমার? মা-বাবা বিচ্ছিন্ন ছোট্ট মেয়েটি বলল, আমার একটা আদর লাগবে। এই টাকাগুলো নিন, আমাকে আদর কিনতে দিন।
দোকানভরা খেলনা, চকলেট, সিন্ডেরেলা জুতো, ফ্রোজেন ফ্রক থাকার পরও মনের কান্না, চোখের কান্না থামছে না ছোট্ট শিশুটির। কারণ বস্তু কখনো প্রাণের বিকল্প হতে পারে না। একটা পর্যায় পর্যন্ত বস্তুর আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারপর বস্তু অতৃপ্তি, হাহাকার, বিষণ্নতা, শূন্যতা তৈরি করতে বাধ্য। যে সম্পর্কের মাঝে বস্তুগত লেনাদেনা চলে আসে সেখানে আত্মিক টানও থাকতে পারে না।
এক ভদ্রমহিলা বলছিলেন-তখন আমার নতুন বিয়ে হয়েছে। স্বামীর সাথে গেলাম তার দুই চাচাতো ভাইবোনের জন্মদিনে। আমার স্বামীর তখন তেমন কোনো উপার্জন ছিল না। আর আপনজনের অনুষ্ঠানে উপহার না দিলেও চলবে মনে করেই গেলাম। পরে একদিন তাদের বাসায় গিয়ে দেখি চাচীর মুখ ভার। ওনার চার বছর বয়সী ছেলেটি বলেই ফেলল, ভাইয়া তো আমার জন্মদিনে কিছু না দিয়েই খেয়ে গেছে। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। সেই মানসিক পীড়ন বয়ে বেড়িয়েছি অনেকদিন। কিন্তু কিছুদিন আগে আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে তাদেরকে দাওয়াত করলাম। কোনো উপলক্ষের কথা বললাম না, যাতে তারা কোনো উপহার না আনেন। দুটো কারণে এটা আমাকে ভীষণ তৃপ্তি দিয়েছে। প্রথমত, আমার দীর্ঘদিনের মানসিক অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছি। দ্বিতীয়ত, উপহারের আশা না করে অতিথিকে আপ্যায়ন করার মধ্যে যে নিখাদ আনন্দ আছে সেটাকে অনুভব করেছি।
আসলে সম্পর্ক হচ্ছে একটি আত্মিক ব্যাপার। মানসিকভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপার। বস্তুর আদান-প্রদান সেটাকে বাড়াতে পারে না। যেমন, সম্পর্কের উন্নয়ন হবে মনে করে আপনি একজনকে দামি একটা গিফট দিলেন। কিন্তু সেটা পেয়ে সে হয়তো ভাবতে শুরু করল, এত দামি গিফট কেন আমাকে দিলো! নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। এ সন্দেহ থেকে এরপর হয়তো সে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে পারে। কাজেই গিফট কখনো সম্পর্ক সৃষ্টি করে না, সম্পর্ক বৃদ্ধিও করে না। তাহলে কী প্রয়োজন? মমতা। অপরপক্ষকে বুঝতে পারা।
সেই লোকটির কথা মনে করুন। যে ভালো হতে চাচ্ছিল, আবার পারছিলও না। কারণ রাতে চুরি না করলে তার আয়-রোজগার কোথা থেকে হবে। আবার চুরি করতে করতে অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় রাতে সে ঘরেও থাকতে পারত না। তখন সে নবীজী (স)-কে অনুরোধ করল, একটি নির্দেশনা দিন যা আমি মানতে পারব। দেখুন, নবীজী (স) তার অবস্থানটা বুঝে শুধু বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি তাহলে মিথ্যা বোলো না। তারপরের ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। রাতের অন্ধকারে লোকটি বের হয়েছে। একজনের মুখোমুখি হলো। সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছো। সে তো মিথ্যা বলতে পারবে না। আবার বলতেও পারবে না যে, চুরি করতে যাচ্ছি। ফিরে এলো বাড়িতে। এভাবে দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিনও পারল না। শেষ পর্যন্ত তাকে আর চুরি ছাড়তে হয় নি, চুরিই তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। প্রিয়জনের মমতার শক্তি এভাবেই জীবনকে বদলে দিতে পারে।
আসলে আদর, স্নেহ, মমতা, ভালবাসার প্রতি এই যে টান, এটি আমাদের সবার অন্তরের গভীর থেকে আসে। যে কারণে যেখানে গেলে মমতা পাওয়া যাবে, সেখানে আমরা ছুটে যাই। যেখানে গেলে স্নেহের পরশ পাওয়া যাবে সেখানে পৌঁছতে আমাদের দেরি হয় না।
ডানাভাঙা পাখির গল্প আমরা জানি। এটি পুরনো একটি গল্প হলেও উপলব্ধির দিক থেকে চির নতুন। এর রচয়িতা কাহলিল জিবরান, একজন লেবানিজ কবি, লেখক ও শিল্পী। গল্পটির নাম দ্য টেম্পেস্ট, অর্থাৎ ঝড়। কারণ গল্পের মূল ঘটনাটি ঘটেছিল ঝড়ের মধ্যেই। গল্পটি এরকম-এক দরবেশ জঙ্গলে থাকেন পরিত্যক্ত একটি ভাঙা ঘরে। ঘরটাকে একটু পরিষ্কার করে নিয়েছেন। ওখানেই তিনি সাধনা করেন। মাঝে মধ্যে জঙ্গলে যান, লাকড়ি-টাকড়ি কুড়ান। লোকালয়ে তেমন একটা আসেন না। কখনো আগুন প্রয়োজন হলে, বাতির প্রয়োজন হলে গ্রামে যান। গ্রামে গিয়ে তেল বা লাকড়ি নিয়ে আসেন। এর মধ্যে একদিন ঝড় হয়ে গেল। ঝড় মানে কী, প্রচণ্ড ঝড়, গাছপালা ভাঙছে একের পর এক। ভাঙা বাড়ির চালের ফুটো দিয়ে পানি টপ টপ করে পড়ছে। দরবেশ ভেতরে বসে আছেন। হঠাৎ ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়েই একটা পাখি এসে পড়ল তার সামনে। ডানা ভাঙা, ডানা ভেঙে গেছে তার, উড়তে পারছে না। দরবেশ এগিয়ে গেলেন, পাখিটাকে ধরলেন। ধরে আগুনের কাছে নিয়ে এলেন। ভিজে সারা শরীর একাকার হয়ে গেছে। আগুনের তাপে তার ভেজা শরীর আস্তে আস্তে উষ্ণ হলো, তার যেহেতু ডানা ভেঙে গেছে, হাড় ভেঙে গেছে, তিনি একটি কাঠি এনে হাড়টাকে সোজা করে জায়গামতো বসিয়ে ওটাকে সুতো দিয়ে বাঁধলেন। একটু হলুদ গরম করে বা মলম-টলম কিছু মেখে দিলেন। এবং তাকে খাবার-দাবার দিতে লাগলেন। একে একে মাস পার হয়ে গেল, পাখির ডানা আবার শক্ত হয়ে গেল, কাঠি খুলে দিলেন দরবেশ। পাখিটি এখন একটু একটু করে উড়াল দিতে পারে। আস্তে আস্তে তার সাহস ফিরছে। এখান থেকে ওখানে, একটু নিচ থেকে উপরে উঠছে, উপর থেকে আরো একটু উপরে উঠছে। সে আবার নিচে নামছে, উপরে উঠছে। দরবেশ সেই পাখির দিকে তাকিয়ে আছেন, ভাবছেন, এই পাখির সাথে কিছুদিন তো খুব ভালোই ছিল, পরিচর্যা করার, সেবা করার খুব চমৎকার সুযোগ পেয়েছিলাম। এখন তো পাখি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সুস্থ হবার পরে আজকে হোক, কালকে হোক, পরশু হোক, সে উড়ে যাবে এবং একদিন পাখি ঠিকই উড়ে গেল। গাছের ডালে গিয়ে বসল। দরবেশ খুব আনন্দের এবং তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মনে মনে ভাবলেন, আসলে ডানা যখন ভাঙা ছিল, তখনই তার জীবনে আমার প্রয়োজন ছিল। এখন পাখি উড়তে শিখেছে, সে মুক্তির আনন্দে অবগাহন করুক, আমি আমার অন্য কাজগুলো করি।
আত্মিক সম্পর্ক এভাবেই দুর্দিনে পাশে এসে দাঁড়ায়, সহযোগিতা করে, সাহস যোগায়, মানসিক আশ্রয় দান করে। আমরা নতুন কিছু করার উদ্দীপনাও পাই এই সম্পর্কগুলোর টানেই। আর পরিবারকে সুখশান্তিতে ভরিয়ে তোলার জন্যে একটি সুন্দর অভ্যাস হচ্ছে সালাম দেয়া। নিজে আগে সালাম দেয়া। পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে যার সাথে দেখা হবে তাকেই। এই সালাম শান্তির বাণী পৌঁছানোর সাথে সাথে আমাদের মধ্যে বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ বাড়াবে। আমাদের পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করবে। এই শক্তি ইনশাল্লাহ সমস্ত অপশক্তিকে মোকাবেলা করতে পারবে যাতে করে আমরা আমাদের জীবনে সুখ ও শান্তি নিশ্চিত করতে পারি।
সুন্দর ও শিক্ষনীয় কথা