মানব সভ্যতার আজকের অগ্রগতির মূল ভিত্তি হচ্ছে কল্পনা। মানুষ কল্পনা করতে না পারলে কিছুই সৃষ্টি করতে পারত না, বানাতে পারত না, আবিষ্কার করতে পারত না। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান সবই মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। তাই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়েও কল্পনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ আজ আমরা আলোচনায় দেখব আমাদের জীবনে এখন আমরা যে যে-ই অবস্থানেই আছি না কেন তা কীভাবে আমাদের কল্পনারই প্রতিবিম্ব। কল্পনা কীভাবে আমাদের মধ্যে বিকশিত হয়, কল্পনাকে কীভাবে ইতিবাচকতার রূপ দিয়ে জীবনে নতুন বাস্তবতা আমরা নির্মাণ করতে পারি।
কল্পনা কী?
অভিধান বলে কল্পনা হচ্ছে মনের ছবি তৈরির ক্ষমতা। চোখের সামনে উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও কোনোকিছুর মানসিক চিত্র তৈরির প্রক্রিয়া; স্মৃতি থেকে ছবি পুনরায় তৈরির মানসিক ক্ষমতা। কল্পনা হচ্ছে বাস্তবতার তোরণ। কল্পনাশক্তি আছে বলেই আমরা যা চাই তা করতে পারি, যা চাই তা হতে পারি। আমাদের বস্তুনিষ্ঠ জীবনও মূলত প্রভাবিত হচ্ছে কল্পনা বা কল্পদৃষ্টি বা কল্পচিত্র দ্বারা।
একজন আর্কিটেক্ট বাড়ি নির্মাণের আগে কী করেন? মনে মনে আগে সেই বাড়ির একটা চিত্র তৈরি করেন। একজন ফ্যাশন ডিজাইনার পোশাক তৈরির আগেই মডেলের গায়ে তা পরালে কেমন লাগবে তা কল্পনায় দেখে নেন। একজন শিল্পীর ছবির পুরোটাই আসে কল্পনা থেকে। একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী সাব-এটমিক পার্টিকেলের জগতকে বোঝার জন্যে কাল্পনিক মডেল তৈরি করেন। দাবাড়ু খেলার কৌশল নির্ধারণেও ব্যবহার করেন কল্পচিত্র।একজন সফল ডাক্তার রোগীকে অপারেশন করার আগেই কল্পনায় দেখে নেন পুরো দৃশ্যটা।
ভিজুয়ালাইজ বা কল্পনার গুরুত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে মনের ছবির সাথে আমাদের অনুভূতি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আমাদের আবেগ মনের ছবি, যেমন মায়ের ছবি, শিশুর ছবি, বন্ধুর ছবির সাথে এমনভাবে সাড়া দেয়, যেন ছবির মানুষটি সামনে রয়েছে। তাই ঘর বা অফিস, বন্ধু বা পরিবারের সদস্য, আনন্দ, দুঃখ, স্মৃতি এবং প্রত্যাশার ছবি আমরা সারাদিনই মনের চোখে দেখতে পাই। আর এ ছবির সাথে আমাদের জীবনদৃষ্টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই মনের ছবি দিয়েই আমরা আমাদের জীবনদৃষ্টিকে পাল্টাতে পারি, জীবনকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে পারি। আর অনেকেই তা করেছেন। যেমন-অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ ব্রুস জেনার তার ড্রইং রুমে চার বছর ধরে একটা হার্ডল রেখেছিলেন। তিনি যখনই এসে সোফায় বসতেন তখনই এই হার্ডলের দিকে তাকাতেন এবং কল্পনায় লাফ দিয়ে হার্ডল ডিঙাতেন। গলফার জ্যাক নিকলাউস গলফ বলে শট মারার আগে মনের ভিডিওতে বল কোথায় নিতে চান এবং কীভাবে নিতে চান পুরোটাই দেখে নিতেন। কল্পনার এই ছবি তাদের ব্যক্তিগত দক্ষতার উৎকর্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ড. রুবাব মো. ইমরোজ খানের কথা আমরা জানি। একজন সফল জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে পেরেছেন কারণ তিনি তা কল্পনা করতে পেরেছিলেন। তিনি বলছিলেন যে, খুব ছোট্টবেলায় তার মা তাদের দুই ভাইবোনকে গল্প বলতেন। বাড়ির ছাদে উঠে আকাশের মিল্কিওয়ে দেখা যায়। তিনি তাদের বাড়ির ছাদে নিয়ে দেখাতেন-দেখ এটা সপ্তর্ষিমণ্ডল, এটা মঙ্গলগ্রহ, ওটা স্যাটেলাইট। ফলে মহাকাশের প্রতি তার কিছুটা আগ্রহ ছোটবেলাতেই তৈরি হয়ে যায়। যখন বই পড়তে শিখলেন তখন তিনি সায়েন্স ফিকশন বই পড়তে শুরু করেন। ক্লাস ফোর/ ফাইভে পড়ার সময় অনেক ধরনের বই কিনে পড়া শুরু করেন। তিনি নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যান চর্চা করতেন। ধ্যানের স্তরে তিনি কল্পনা করতে শুরু করলেন যে তিনি একজন বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন, তিনি পদার্থবিদ্যা, মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করছেন। তিনি কিন্তু এসব ভেবে মনছবি করতে বসেন নি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার কল্পনাতে বিষয়গুলো চলে এসেছে। পরবর্তীতে সেই কল্পনাই বার বার মনের চোখে করে গেছেন এবং ২০ বছর পরে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি এবং তার নেতৃত্বে একটি দল মহাকাশে নতুন পাঁচটি সুপারস্টার বা অতিতারকার অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজে পান। নাসার একজন তরুণ মহাকাশ বিজ্ঞানী হিসেবে তখন তিনি আত্মপ্রকাশ করেন।
তিনি সাফল্য পেলেন কীভাবে? তার কল্পনার মাধ্যমে। কল্পনার বীজ কীভাবে অঙ্কুরিত হয়েছিল? একটি তথ্যের সাথে আরেকটি তথ্য জোড়া লাগতে লাগতে কল্পনা তৈরি হয়েছিল। ধারণা থেকে কল্পনা, তা থেকে বিশ্বাসযুক্ত কল্পনা, তা থেকে কাজ, তারপর বাস্তবতা। শৈশবে মায়ের ছাদে নিয়ে মিল্কিওয়ে দেখানো মহাকাশ নিয়ে একটি ধারণা, সায়েন্স ফিকশন বই পড়া-বিশ্বাসযুক্ত হওয়া, মেডিটেটিভ লেভেলে জীবনের একটা লক্ষ্যস্থির করা, একটা মনছবি তৈরি করা অর্থাৎ কাজ এবং ২০টি বছর সেই লক্ষ্যের পেছনে লেগে থাকা। কল্পনাকেই বলা হয় মনছবি। অর্থাৎ মনের গভীরে যা হতে চাই বা পেতে চাই তার একটা ছবি এঁকে ফেলা। মূলত এগুলোই আজকের ড. রুবাব খান-এর সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে।
আমরা অধিকাংশ মানুষ কল্পনা করি একটার পর একটা তথ্যকে জোড়া লাগিয়ে। আমরা কল্পনার জগতে বাস্তবে সামনে নেই এমন জিনিসের যেমন চিত্র দেখতে পাই, তেমনি শুনতে, গন্ধ শুঁকতে, স্বাদ গ্রহণ ও অনুভব করতে পারি। কীভাবে? ধরুন এখন আমি যদি ‘আম’ বলি। আপনারা কী আম-কে কল্পনা করতে পারবেন? পারবেন। এই মুহূর্তে ‘আম’ আমাদের সামনে নেই তারপরও আমরা পারব। কারণ আম দেখতে কেমন হয়, ধরতে কেমন হয়, আমের স্বাদ কেমন সেটা আমরা জানি। আম সম্পর্কে সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। তথ্য যত বেশি থাকে কল্পনা তত স্পষ্ট হয়।
আমাদের সুস্থতা, আমাদের সুখ, আমাদের প্রশান্তি, অনেক সুন্দর পেশা জীবন বা অনেক সুন্দর ক্যারিয়ার এর পেছনে মূল কারণ কী? মূল কারণ আমরা এটা কল্পনা করতে পেরেছি। একটা কথা আছে, Everything is pre-destined. যেটাকে আমরা মনে করি যে নিয়তি। আসলে নিয়তি আমরা নিজেরাই আমাদের চিন্তা এবং কর্মের মাধ্যমে তৈরি করি।
আজ যদি আমার সাথে কারো সম্পর্ক খুব খারাপ যায়, স্বামী, স্ত্রী, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই-বোন, ননদ-দেবর, ছেলে-মেয়ে, প্রতিবেশী, অফিসের সহকর্মী যে-কারো সাথে। তার কারণ কী? তার কারণ আমাদের চিন্তা, চিন্তা থেকে কল্পনা। ধরুন একজন সম্পর্কে যখন আমরা বলি যে, তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক হয় না। তার সাথে দেখা হলেই কথা কাটাকাটি হয়। তার সাথে দেখা হলেই মন বিমর্ষ হয়ে যায়। এই কথাগুলোই আবার যখন অন্যদেরকে বলছি বা নিজেই নিজেকে বার বার শোনাচ্ছি, তখন কী হচ্ছে? এই ধারণাটা আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করছি। মনকে আমরা তার সম্পর্কে বার বার নেতিবাচক তথ্য পাঠাচ্ছি। আর মন সেই তথ্য দিয়ে একটা কল্পচিত্র তৈরি করে ফেলছে। যখন বাস্তবে তার সাথে দেখা হচ্ছে। তখন খারাপ কোনো আচরণই হচ্ছে। কেন? কারণ আমরা সেটাই কল্পনা করেছিলাম।
লিও টলস্টয়ের একটি গল্প আছে- ‘সামান্য ডিম নিয়ে‘। দুজন প্রতিবেশী তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এক প্রতিবেশীর বাড়ির উঠোনে গিয়ে পাশের প্রতিবেশীর মুরগি ডিম পেড়ে চলে এসেছিল। তো বাড়ির গৃহিণী গিয়ে পড়শী মহিলাকে জিজ্ঞেস করাতে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন আমাদের মুরগি এত ডিম পাড়ে আমরা কেন তোমার ঐ একটা মরগির ডিম নিতে যাব? সেই গৃহিণীও দু‘কথা শুনিয়ে দিলে তাতে ঝগড়া বাধে। বাড়ির পুরুষরাও এসে এককথা, দু‘কথায় ঝগড়ায় যোগ দেয়। ঝগড়া হাতাহাতিতে রূপ নেয়। কিছু ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তো যার ক্ষতি হয়েছে সে গিয়ে আদালতে মামলা করায় যার বিরুদ্ধে মামলা করেছে তার জেল হয়। মামলার কারণে দুপক্ষেরই অনেক অর্থ এবং সময় নষ্ট হতে থাকে।
তাদের ঝগড়া কমে না, দিন দিন শুধু বাড়ে। একদিন যার নামে মামলা করা হয় তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আরেক প্রতিবেশীকে বলেন, তিনি এর প্রতিশোধ অবশ্যই নেবেন। কী প্রতিশোধ নেবেন তা বলেন নি। এটা যখন সেই প্রতিবেশীর কানে গেল তখন প্রতিবেশীর মনে হতে থাকল হয়তো প্রতিশোধ নিতে সে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। অপর প্রতিবেশী কিন্তু বলেন নি যে তিনি আগুন লাগাবেন। কিন্তু এই প্রতিবেশী কল্পনা করতে থাকলেন। এবং শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি অপর প্রতিবেশী আগুন লাগাল। তাতে দু বাড়িই পুরে ছাই হয়ে যায়। আসলে আমরা যখন কোনোকিছু কল্পনা করতে থাকি তখন আমরা সেই অনুসারে কাজ করতে থাকি। ঘটনাটি এ কারণে বললাম কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যত ঘটনা আমাদের সাথে ঘটে তা প্রথমে কল্পনাতে ঘটে তারপর তা বাস্তবে ঘটে।
যিনি অসুস্থ হন তিনি কীভাবে অসুস্থ হন? কেউ হয়তো তাকে দেখে বললেন আপনার শরীর ভালো তো? আরেকজন বললেন, আজ আপনাকে দুর্বল লাগছে, আরেকজন বললেন খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করেন শরীরের যে অবস্থা, এমন থাকলে তো বিছানায় পড়ে যাবেন। আরেকজন বললেন আপনাকে খুব রোগা লাগছে। এই যে এতগুলো তথ্য। একটার পর একটা তথ্য মিলে আমরা চিন্তা করতে শুরু করি আমি অসুস্থ। আমি অসুস্থ। অসুস্থ হওয়ার পর সুস্থ হতে সময় লাগে। কারণ তখনো বার বার ভাবতে থাকি আমি অসুস্থ। মস্তিষ্কে বার বার মেসেজ পাঠাতে থাকি আমি অসুস্থ।
ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে দিলেন এবং বলে দিলেন তিন দিনে ভালো হয়ে যাবেন। যদি ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করি আর তার নির্দেশমতো কাজ করি তাহলে তিন দিনে সুস্থ হয়ে যাব। কিন্তু সুস্থ হতে সময় লাগে কেন? বাসায় ফিরলাম, এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হলো, সে বলল আমার তো পাঁচ দিন লেগেছিল। তখন আবার গুগল সার্চ করলেন। গুগলে কয়েকটা আর্র্টিকেল পড়ে জানা গেল তারাও বলছে বেশিরভাগের পাঁচ দিন লাগে। সেইসাথে আরেকটু আগ বাড়িয়ে যদি দেখলেন ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী? দেখলেন ক্লান্তি, অবসাদ, ঝিমুনি, মাথা ঘোরা হবে এই ওষুধ খেলে। এগুলো করে আমরা মস্তিষ্ককে একটার পর একটা তথ্য পাঠাচ্ছি। তথ্য যেতে যেতে একটা কল্পনা তৈরি হচ্ছে। আর কল্পনা সেই বাস্তবতা তৈরি করছে।
কয়েকবছর আগে চিকুনগুনিয়া আমাদের দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছিল। কারণ জ্বর আসার পর যে-ই শুনছে চিকুনগুনিয়া, তখন জ্বর আর সারছে না, গিটে গিটে ব্যথা এবং আর যা লক্ষ্মণ সব বেরিয়ে আসছে। জ্বরাক্রান্ত কিছু লোককে বলা হয়েছিল যে তাদের ভাইরাস জ্বর হয়েছে। যাদের বলা হলো ভাইরাস জ্বর তারা তিন দিনে ভালো হয়ে গেলেন। আর যারাই জেনেছেন চিকুনগুনিয়া তাদের তিন মাস, ছয় মাস লেগেছে।
আসলে আমরা তথ্য অনুযায়ী প্রতিটি কল্পনা তৈরি করছি। ফলে সে-রকম বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। তাই আমাদের সবসময় এটা মাথায় রেখে কোনোকিছু ভাবতে হবে যে আমি যা ভাবছি, কল্পনা করছি তা বাস্তবতা সৃষ্টি করার দিকেই এগুচ্ছে। সেজন্যে কী করতে হবে? নেতিবাচক চিন্তা, নেতিবাচক কথার ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। নেতিবাচক চিন্তা চলে এলে তওবা, তওবা বা বাতিল বাতিল বলে ইতিবাচক কথা বলতে হবে। ইতিবাচক কল্পনা করে দৃশ্যপট পাল্টে দিতে হবে।
ইতিবাচক তথ্য ব্রেনে পাঠাতে হবে। কারণ আমরা যে কথা বলছি তা আরেকজনের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের সন্তানদের। সন্তান কার কথা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে? মা-বাবার কথা। এখন বাবা-মা যদি বলতে থাকেন তুই একটা বোকা, অপদার্থ, মূর্খ; তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। সন্তান এটাই বিশ্বাস করবে। এটাই কল্পনা করবে। বার বার নিজের মধ্যে এই তথ্যই দিতে থাকবে আমি অপদার্থ, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তখন সেই বাস্তবতাই তৈরি হবে। তাই বাবা-মা যদি সন্তানকে বলেন তুমি অনেক সৃজনশীল, তুমি অনেক বড় হবে, অনেক ভালো কিছু করবে, সমাজ সেবক হবে, গবেষক হবে, বিজ্ঞানী হবে, ভালো মানুষ হবে। বার বার সন্তান যদি বাবা-মায়ের কাছ থেকে, চারপাশের পরিচিতদের কাছ থেকে ইতিবাচক কথা শোনে তাহলে ইতিবাচক তথ্য ব্রেনে যাবে, সে তখন সে-রকম কল্পনা করতে পারবে। এবং সে-রকম বাস্তবতা নির্মাণ করবে।
টমাস আলভা এডিটেশনের মেধা কম ছিল বলে স্কুল তার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। চিঠিটি মায়ের হাতে দেয়ার পর, মা চিঠিটি পড়ে চোখ মুছে ছেলেকে বলেছিলেন চিঠিতে লেখা আছে,‘আপনার ছেলে খুব মেধাবী, এই স্কুলটি তার জন্যে অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ মায়ের এই কথা শুনে ছোট্ট ছেলেটির মনে কী হলো? তার নিজের প্রতি উচ্চ ধারণা তৈরি হয়েছিল যে সে অনেক মেধাবী। এতটাই মেধাবী যে শিক্ষকরা তাকে পড়াতে পারছেন না! কিন্তু খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হওয়ার অনেক পরে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, আসলে চিঠিতে লেখা ছিল, তার কোনো মেধা নেই, শিক্ষকদের অহেতুক প্রশ্ন করে সে বিরক্ত করে, তাকে স্কুলে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব না। এই ঘটনাটি এই কারণে বলছি যে, আমরা ব্রেনকে যে তথ্য পাঠাব ব্রেন সেই ছবি তৈরি করবে এবং পরবর্তীতে সেই বাস্তবতা ব্রেন আমাদের উপহার দেবে। তাই নিজের ব্যাপারে বা অন্য যে-কারো ব্যাপারে কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার প্রয়োজন আছে।
বাস্তবতা আমাদের কল্পনার প্রতিবিম্ব আর এখনকার সময়ে আমাদের অধিকাংশের কল্পনা কার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়? মিডিয়ার দ্বারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দ্বারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মিডিয়াতে যা দেখি আমরা কিন্তু অবচেতনভাবে সেভাবে কল্পনা করতে থাকি। ফলে আমাদের বাস্তব জীবনে তাই ঘটতে থাকে। আর নেতিবাচক বিষয়গুলোই বেশি ঘটতে থাকে। তাই আমরা যদি চাই যে আমাদের বাস্তবতা ইতিবাচক হোক তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার ব্যবহারে আমাদের নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।
আমরা সবাই চাই আমাদের জীবন সুখ, সুস্থতা, প্রশান্তি, প্রাচুর্য় সাফল্যে পরিপূর্ণ থাকুক। কী চাচ্ছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমি কী চিন্তা করছি, কী কল্পনা করছি। চাইছি কিন্তু যতক্ষণ না তা কল্পনা করতে পারব ততক্ষণ তা আমাদের জীবনে আসবে না। আর এখানেই মেডিটেশনের গুরুত্ব। নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করে লাখো মানুষ তাদের জীবন বদলে ফেলেছেন। নতুন করে নিজেদের গড়েছেন। মেডিটেশন চর্চা করে রোগকে সুস্থতায়, ব্যর্থতাকে সাফল্যে, অভাবকে প্রাচুর্যে রূপান্তর করেছেন।
ধরুন, কেউ ভাবতে লাগলেন যে তাকে কেউ তাড়া করছে পেছনে, ছোরা নিয়ে। এই কল্পনা তার মনে আশঙ্কাবোধ এবং টেনশন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ছোরা নিয়ে দৌড়াচ্ছে, এটা ভাবার দরকার কী? ভাবলেই তো হয় যে ফুল নিয়ে দৌড়াচ্ছে। বেচারা দৌড়ে আমার সাথে পারছে না, ফুলটা দিতেও পারছে না। ছোরার জায়গায় ফুলের কথা ভাবলে মনটা দেখুন কত ফুরফুরে হয়ে যায়। নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করে এভাবেই আপনার চিন্তার চ্যানেলটা সহজে পরিবর্তন করতে পারেন। কারণ মেডিটেশনে আমরা মনের গভীরে গিয়ে আমাদের ব্রেনকে যে কমান্ড দেই ব্রেন তা বাস্তবায়ন করার কাজে নেমে পড়ে। কারণ আমাদের ব্রেনের ভাষা হচ্ছে ছবি। ছবি যত নিখুঁত হয় বাস্তবতাও তত চমৎকার হয়। আমরা আমাদের আলোচনায় সফল এবং ব্যর্থ মানুষদের উদাহরণ থেকে দেখলাম যে আজকের যা বাস্তবতা তা আসলে আমাদের কল্পনারই প্রতিবিম্ব। যারা সফল তারা সফল কারণ তারা সাফল্যকে প্রতিনিয়ত কল্পনা করছেন। আর যারা ব্যর্থ তার কারণও তাদের কল্পনা। তারা প্রতিনিয়ত ব্যর্থতাকে কল্পনা করছেন। তাই সফলদের মতো আমরাও যদি সফল হতে চাই তাহলে কী করতে হবে? আমাদের তথ্যের পুনর্বিন্যাস করতে হবে। যা হতে চাই সেই ছবি মনের ভেতরে এঁকে ফেলতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি যখন সঠিক হবে, মন যখন প্রশান্ত হবে, মনের কল্পনা, মনছবি তত সুন্দর হবে; বাস্তবতাও তত চমৎকার হবে। পরম করণাময় আমাদের সবাইকে কল্পনার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সফল সুখী পরিতৃপ্ত মানুষ হওয়ার তৌফিক দান করুন।