অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে মেডিটেশনের গুরুত্ব এখন তীব্রভাবে অনুভব করছে সমাজের সচেতন অংশ। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতোই একটি মৌলিক চাহিদা হয়ে উঠছে মেডিটেশন। আসলে আমরা যদি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে দেখি, বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখব যে কোভিড মহামারি বা অতিমারির সময়ে দেশে এবং বিদেশে ধ্যান থেকে, মেডিটেশন থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন মানুষ। যারা ধ্যানের ইতিবাচক শক্তিকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করেছেন তারা সবচেয়ে বেশি সুফল পেয়েছেন। যারা মেডিটেশন, প্রাণায়াম, যোগের অনুশীলন করেছেন; করোনাকালে সবচেয়ে সুস্থ এবং সবচেয়ে আতঙ্কমুক্ত জীবন তারা যাপন করেছেন।
একদিক থেকে আমরা বেশ ভাগ্যবান একটি প্রজন্ম। আমরা প্রি-কোভিড সময় দেখেছি, অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চের আগের জীবনটা আমরা অতিবাহিত করেছি। আমরা কোভিড কাল পার করেছি; লকডাউন, শাটডাউনের মতো আজাব-গজব কেমন হতে পারে তা উপলব্ধি করেছি। সামনে আমরা দেখতে যাচ্ছি পোস্ট কোভিড কাল। সুকুমার রায়-এর এক বছরের রাজা গল্পটি তো আমাদের জানা আছে। বড় গল্প, তাই নতুন করে বলছি না। গল্পটির মাঝে আমরা যে শিক্ষাটি দেখতে পাই তা হলো-বর্তমানে কী করতে হবে সে ব্যাপারে মনোযোগী হতে পারলে, করণীয় এবং পদক্ষেপগুলো ঠিক করে নিতে পারলে ভবিষ্যৎ সুন্দর হবেই। যেভাবে রাজা সেই মৃত্যুপুরীকে বসবাসের উপযোগী করায় এক বছরের মাথায় তাকে আর নির্বাসনের জীবন ভোগ করতে হয় নি। বরং সেখানে তার নতুন রাজত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।
কোভিড পরবর্তী জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ার জন্যে এখনই যদি আমরা মনোযোগী হই, যথাযথ পদক্ষেপ নেই, তাহলে পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে অবশ্যই তা আমরা পারব।
কী সেই যথাযথ পদক্ষেপ?
বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, করোনাকালে মানুষের মাইন্ড ও ব্রেনের যে টিউনিংটা ভারসাম্য হারিয়েছে, তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্যে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডে ইতোমধ্যে পোস্ট কোভিড ট্রমা থেকে মুক্ত থাকার জন্যে মেন্টাল হেলথ ক্লিনিক তৈরি করেছে। এ বছর জুনে নিউসায়েন্টিস্ট-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পোস্ট কোভিড ক্লিনিকে এখন দম ও ইয়োগা শেখানো হচ্ছে।
কেন এই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলা হচ্ছে?
প্রশ্ন করতে পারেন যে, মাইন্ড ও ব্রেনের টিউনিংটা যে ভারসাম্য হারিয়েছে, তা বোঝা গেল কেমন করে? খুব সহজ। একটু খেয়াল করে দেখুন, চারপাশে যারা আছেন, তাদের মধ্যে অস্থিরতা, হতাশা, বিষণ্নতা, ক্রোধ, ক্ষুব্ধতা, জেদ, অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা, উত্তেজনা আছে কিনা। আছে। কেন এই ভারসাম্যহীনতা? কারণ আমাদের স্বাভাবিক জীবন আগের মতো পুরোপুরি স্বাভাবিক নেই। প্রতিদিনের ব্যস্ততার ছন্দপতন ঘটেছে। পেশাজীবীরা তাদের পেশার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ব্যবসায়ীরা নতুন পদক্ষেপ নিতে সিদ্ধান্তহীন। কর্মহারা অনেক মানুষের মধ্যে কাজ করছে নেতিবাচকতা। আতঙ্কের কারণে আজো যারা ঘরবন্দি, তারাও হাঁপিয়ে উঠেছেন, কিন্তু বাইরে বের হওয়ার সাহস করতে পারছেন না। এদিকে ভার্চুয়াল ভাইরাসের আসক্তি নতুনভাবে সৃষ্টির কারণে ঘরে ঘরে অশান্তি বেড়ে গেছে, মানুষের নৈতিকতার বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে। বিশেষত আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ আজ তাদের জীবনের লক্ষ্য এবং বড় কিছু করার উদ্যম হারিয়ে ফেলার পথে। করোনা ভাইরাসের চেয়েও ভার্চুয়াল ভাইরাস এই করোনাকালে তাদের ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষভাবে ১৮ বছরের কম যাদের বয়স, সেই তরুণ-তরুণীদের। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের শিক্ষার জন্যে অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন স্মার্টফোন। এখনই আমরা যদি সঠিক উদ্যোগটি নিতে না পারি তবে জাতিগতভাবে আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো যা কাটিয়ে উঠতে বহু সময় লেগে যাবে। গবেষকগণ এখন এই পোস্ট কোভিড ট্রমা কাটিয়ে ওঠার উপায় নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পোস্ট কোভিড ট্রমা মোকাবেলায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে কারণ আমাদের জাতির যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ধ্যানের ঐতিহ্য, ধর্ম পালনের ঐতিহ্য, সমমর্মিতার ঐতিহ্য আমাদেরকে বলে দেয় যে, যে-কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সক্ষম জাতি। আমরা প্রভুর বিশেষ অনুগ্রহভাজন জাতি। এর আগে যত বিপর্যয় আমাদেরকে আঘাত হেনেছে, আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নতুনভাবে জীবন শুরু করেছি। এবারও ইনশাল্লাহ পারব। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পোস্ট কোভিড ট্রমা ম্যানেজমেন্ট ক্লিনিকে যা শেখানো শুরু হয়েছে, পরম করুণাময়ের অনুগ্রহে আমাদের দেশের মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাণায়াম, মেডিটেশন, ইয়োগা, যত্নায়ন, শুকরিয়ার জীবনদৃষ্টি লালনে ও আশাবাদী জীবনে অভ্যস্ত। জীবনকে সাজাতে, জীবনকে গোছাতে এরচেয়ে বেশি আর কী লাগে!
আসলে জীবনের যা যা সংকট বা যেটাকে আমরা সংকট মনে করি এটা সৃষ্টি হয় কিন্তু আমাদের দ্বারাই। সমস্যা ছাড়া কোনো জীবন নাই। এমন কোনো জীবন নাই যে জীবনে সমস্যা ছিল না বা নেই। জীবন মানেই হচ্ছে একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ আসবে। যেদিন সমস্যা আসবে না, সেদিন বুঝবেন যে you are no more. আপনার আর প্রয়োজন নাই। কারণ সমস্যা থেকে ক্রমাগত উত্তরণের নাম হচ্ছে জীবন। জীবন যতদিন আছে, সমস্যা আসবে and you have to face it.
ধ্যানীরা সবসময় প্রশান্ত থেকে সমাধানের দিকে নজর দেন সাধারণভাবে আমাদের সমস্যাটা কোথায়? আমরা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি বেশি। সমাধান নিয়ে চিন্তা করি কম। যার ফলে অস্থির হয়ে যাই। আপনি একটা জিনিস নিয়ে যত চিন্তা করবেন, এটা কিন্তু ডালপালা ছড়াতে থাকবে। আচ্ছা কী হতে পারে? আমি রাস্তা দিয়ে যাব, যদি কোনো ছিনতাইকারী আক্রমণ করে? কী হতে পারে? আচ্ছা টাকা-পয়সা নিয়ে গেল। আচ্ছা যদি ছুরি মারে তাহলে কী হতে পারে? আমি যদি আহত হয়ে যাই তাহলে কী হতে পারে? অর্থাৎ আমরা উল্টো চিন্তাটা করি। আমরা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি; সমাধান নিয়ে চিন্তা করি না। আমি সুন্দরভাবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গন্তব্যে যাব-এ চিন্তা প্রথমে আসে না। যার ফলে আমাদের জীবন কাল্পনিক বিপদ দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়ে যায় এবং একসময় বাস্তবে সংকট সৃষ্টি হয়।
আবার কখনো কখনো বাস্তবে সত্যিই বিপদ, সমস্যা আসে। আমরা অস্থির হয়ে যাই যে কত দ্রুত সমাধান হবে। কারণ আমাদের প্রকৃতি হচ্ছে অস্থির। প্রত্যেকটা সমস্যা সমাধানেরও একটা সময় আছে, কাল আছে। ঐ কাল অতিক্রম না করা পর্যন্ত সমাধান হবে না। যেমন জ্বর যদি আসে ভাইরাস যদি হয়, তিন দিন লাগে আপনার সুস্থ হতে। একেকটা রোগের যেরকম একেকটা টাইম স্প্যান আছে। ওষুধেরও কিন্তু টাইম স্প্যান আছে যে, ঐ ওষুধ অতদিন খেলে পরে আপনি ভালো হবেন। আমি চাইলেই একদিনে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না। আমাকে কী করতে হবে? সমস্যা উত্তরণের জন্যে সময় দিতে হবে। কারণ সমস্যাটা যেরকম একদিনে আসে নি, সমস্যার উত্তরণও একদিনে হবে না।
তাহলে কী করতে হবে? আপনি যত ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারবেন, যত কুশলী হবেন, যত ডিপ্লোমেটিক হবেন, যত বুদ্ধি এবং কৌশল প্রয়োগ করতে পারবেন তত সমস্যার সমাধানটা দ্রুত হবে।
ধরুন কারো সাথে আপনার ঝগড়া সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এখন আপনি যদি উত্তেজিত হয়ে যান, ঝগড়াটা প্রলম্বিত হবে। আর আপনি যদি বোঝেন যে আচ্ছা, ও তো এখন উত্তেজিত হয়েছে। Let me wait. একটু পরেই তিনি ঠান্ডা হয়ে যাবেন। এজন্যে তাকে বলতে বরং আরো উৎসাহিত করুন যে, আসলে তো আপনার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমাকে তো বলাই উচিত। দেখবেন যে তার বলার আগ্রহটা কমে গেছে।
স্বামী/ স্ত্রীতেও অনেক সময় এমন হয়। এক্ষেত্রে সবসময় ভাববেন, আমাকে না বললে ও আর কাকে বলবে। আর আপনি যখন এই তুমি কী বলছ, এতদিনের সংসার; তোমার জন্যে আমি এই করলাম, এই করলাম, এই করলাম, বাড়ি কিনে দিলাম, গাড়ি কিনে দিলাম আর তুমি এই কথা বলছ? স্ত্রী কী করবেন? আপনি যে কিছুই করেন নাই তিনি সেটা প্রমাণ না করা পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হবেন না।
অথচ আস্থার সাথে এবং কুশলতার সাথে যদি ঠিক করতে পারেন যে, কী বললে তিনি খুশি হবেন, এবং আপনি যদি সেটা প্রয়োগ করেন, তাহলে আপনি সমস্যাটাকে খুব দ্রুত সমাধান করে ফেলতে পারবেন। এবং এই কাজটাই করে মেডিটেশন। অধিকাংশ ধ্যানীদের পরিবার যে সুখী পরিবার, এজন্যেই। স্বামী উত্তেজিত হলে স্ত্রী প্রশান্ত থাকেন, আবার স্ত্রী উত্তেজিত হলে স্বামী মৌন থাকেন। এক হাতে তো তালি বাজে না। যে কারণে মিটমাট হতেও সময় লাগে না। বাসায় থাকে শান্তি আর শান্তি। ধ্যানের শক্তি পারিবারিক বন্ধনকেও শক্তিশালী করবে।
আমরা ধ্যানী জাতি আর জেনেটিক্যালি আমরা যে ধ্যানের শক্তি নিজেদের মধ্যে বহন করছি, তার কারণ হচ্ছে ধ্যানের জন্মভূমি হচ্ছে এই বাংলা। মেডিটেশনের বিকাশও হয়েছে এই বাংলায়। বাংলায় মেডিটেশনের সবচেয়ে বড় বিস্তার ঘটেছে মহামতি বুদ্ধের সময়। সেই আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধ এই ধ্যানকে বাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়েছেন। এই ধ্যান বাংলা থেকে চীনে গেল। এটা চীনে গিয়ে হয়ে গেল চেং। চীন থেকে জাপানে গেল। জাপানে গিয়ে হয়ে গেল জেন। এখন আমরা যে জেন শব্দটি বলি, পুরো ইউরোপ-আমেরিকাতে ধ্যানের আরেকটি বিকল্প শব্দ হচ্ছে জেন। এবং জেন শব্দটি হচ্ছে বাংলা ধ্যান শব্দেরই পরিবর্তিত রূপ।
মহামতি বুদ্ধেরও চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের মুনি, ঋষিরা এই ধ্যানের চর্চা করেছেন, যোগের চর্চা করেছেন। কেন? মাথাটাকে ঠান্ডা রাখার জন্যে। দেহটাকে ফিট রাখার জন্যে। মনটাকে স্থির করার জন্যে। এবং তারা যোগ-ধ্যানের যে প্রক্রিয়া সেই চার হাজার বছর, পাঁচ হাজার বছর আগে আবিষ্কার করেছেন, প্রয়োগ করেছেন নিজেদের জীবনে এরচেয়ে ভালো কোনো প্রক্রিয়া, ভালো কোনো পন্থা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারে নাই। শাস্ত্রবিজ্ঞান এতদূর এগিয়েছে, কিন্তু শাস্ত্রবিজ্ঞানও শেষ পর্যন্ত বলছে যে না This is the best. এই ধ্যান, এই যোগ, এই মেডিটেশন-এটা হচ্ছে নিজেকে শান্ত করার, স্থির করার, ধীর করার এবং নিজেকে আত্মপ্রত্যয়ী করার, বিশ্বাসী করার, সমমর্মী করার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি।
আসলে মেডিটেশন কী করে?
মেডিটেশনকে আমরা আধুনিক পরিভাষায় বলি-মনের ক্লিনিং সিস্টেম এবং মস্তিষ্কের কুলিং সিস্টেম। মাথাটাকে ঠান্ডা করা এবং মনটাকে পরিচ্ছন্ন করা-আবর্জনা মুক্ত করার নাম হচ্ছে মেডিটেশন বা ধ্যান। মেডিটেশন বলি, মোরাকাবা বলি, ধ্যান বলি একই জিনিস। ইংরেজিতে মেডিটেশন, বাংলায় ধ্যান, আরবি-ফার্সিতে মোরাকাবা মোশাহেদা। একই জিনিস। প্রক্রিয়াগত কিছু কিছু পার্থক্য আছে। কিন্তু মূল জিনিস হচ্ছে এক এবং মেডিটেশন করা খুব সহজ। যে-কারণে যে-কেউ মেডিটেশন করতে পারেন। এবং মেডিটেশন করে মনটাকে প্রশান্ত করতে পারেন।
মনে যত রাগ-ক্ষোভ, ঘৃণা-নেতিবাচক আবেগ যেটা আপনাকে আসলে ভুল করতে বাধ্য করে, তা ঝেড়ে ফেলতে পারেন। যেমন, আপনি যখন রেগে যান রেগে গিয়ে আপনি যে কাজটা করেন সেটার জন্যে পরে আবার অনুশোচনা করেন। নিজে বলেন, সরি ভাই/ আপা/ ভাবী মাফ কইরা দিয়েন। আমিতো মানে …… তার মানেটা কি? যখনই আপনি রেগে যাচ্ছেন, মনের রাগ মনের নেতিবাচক আবেগ যখন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছে তখন আপনি এমন কাজ করছেন যার জন্যে আপনি পরে অনুতপ্ত হচ্ছেন। দরকার কি তাহলে রাগ করে, আবার ঠান্ডা হয়ে তারপর অনুতপ্ত হওয়ার। শুরু থেকেই প্রশান্ত থাকলে হয়। এজন্যে আমাদের রাগ, ক্ষোভ নামে মেডিটেশন অডিও আছে, করতে পারেন।
মেডিটেশনের আরেকটি প্রাপ্তি হচ্ছে মনোযোগায়ন, মনোযোগকে একাগ্র করা। আমাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত থাকে। বিক্ষিপ্ত মনোযোগকে এক জায়গায় স্থির করার নাম হচ্ছে মনোযোগায়ন। আজকে সারা পৃথিবী বিশেষত পাশ্চাত্য, যারা ভার্চুয়াল ভাইরাসে আমাদের আগে আক্রান্ত হয়েছে, আমরা তো এখন আক্রান্ত হয়েছি, মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে, মনোযোগ নাই। কীসের প্রতি মনোযোগ নাই? নিজের প্রতিও না, মানুষের প্রতিও না, ভালো জিনিসের প্রতিও না, কোনো কিছুর প্রতিই মনোযোগ নাই। এই যে মনোযোগহীনতা, এই কারণেই পাশ্চাত্যে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়তা লাভ করছে এই ধ্যান। তো যখনই দেহ স্নায়ু-পেশী ধীর হলো, স্থির হলো, শিথিল হলো, মনটা স্থির হলো, মনোযোগায়নটা একীভূত হলো, মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হলো এক বিন্দুতে, তখনই মস্তিষ্ক বেশি পরিমাণে ব্যবহার করার সুযোগ বেড়ে গেল। এজন্যে শিথিলায়ন কিংবা আনন্দের মেডিটেশন অডিও আছে, চর্চা করতে পারেন।
মস্তিষ্ককে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করার জন্যেই মেডিটেশন
যে মাথাটাকে ঠান্ডা রাখতে পারে, সে যে-কোনো সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে পারে।যখনই আপনি মাথা ঠান্ডা রাখবেন আপনার জীবনে যত সমস্যা আসুক এই সমস্যাটাকে আপনি নতুন সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করতে পারবেন। কারণ মানুষ যখনই সমস্যায় পড়েছে সে তার এই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করেছে এবং সমস্যাকে জয় করেছে। এবং মানুষ তার সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছে এই মস্তিষ্কটাকে ব্যবহার করে। ছোট্ট উদাহরণ দেই। ধরুন মানুষ দেখল যে, সে ঘোড়ার মতো দৌড়াতে পারে না। সে কী করল? বুদ্ধি করে ঘোড়ার পিঠে ওঠে বসল। যে তুই দৌড়া, আমি বসে থাকি। আমি বসে থাকি। যখন দেখল ওটাতেও অত আরাম নাই, চাকা বানালো। দুটা চারটা আটটা চাকা দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি বানালো, যে তোরা দৌড়া আমি শুয়ে থাকি। অর্থাৎ মানুষ তার সমস্ত জৈবিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছে এই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে। সে দেখল যে, সে একটা পাথর ভাঙতে পারে না। হাতুড়ি বানালো, পাথর গুঁড়া করে ফেলল। সে দেখল যে, পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। সে যেতে পারছে না। ডিনামাইট বানালো, পাহাড় গুঁড়িয়ে দিল; সুড়ঙ্গ তৈরি করে পথ করে নিল।
অর্থাৎ মানুষ তার সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছে এই মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে। আর মেডিটেশন মাথাটাকে ঠান্ডা রেখে মস্তিষ্কটাকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করার পথই করে দেয়। এবং যখনই আপনি মস্তিষ্কটাকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে পারবেন সমস্যাগুলো নতুন সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হবে, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন সুযোগ। তাই যারা কর্ম অনুসন্ধানী আছেন, তারা মনছবির মেডিটেশনটি নিয়মিত করুন। বিশ্বাসের সাথে যেন মনছবি করতে পারেন সেজন্যে মনের গভীরে লুকানো হীনম্মন্যতা দূর করতে হও উন্নত শির মেডিটেশনটি করুন। যাদের মনে এখনো আতঙ্ক কাজ করছে তারা ভয় ও নেতিচিন্তা দূর করার মেডিটেশনটি করুন। শুকরিয়ার মেডিটেশনটি করুন। দেখবেন যে কল্যাণকর যে-কোনো কাজে যুক্ত হওয়ার মনোবল বাড়ছে।
প্রতিদিন মেডিটেশন করুন আর সবার প্রতি অনুরোধ-যখনই সময় পাবেন, যখনই সুযোগ পাবেন দিনে মেডিটেশন করবেন একবার। দুবার করতে পারলে খুব ভালো। দুবার যদি করতে না পারেন অন্তত দিনে একবার মেডিটেশন করবেন। সকালবেলা দিন শুরু করবেন মেডিটেশন করে। মাথা ঠান্ডা থাকবে, মনটা স্থির থাকবে। আসলে আমরা অনেক সময় বুঝি না। ধরুন আপনার একটা কম্পিউটার সুপার কম্পিউটার আছে। এবং ওখানে যে-কোনো ডাটা দেন মুহূর্তে প্রসেস করে আপনাকে সলিউশন দিয়ে দেবে। আপনাকে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে। কিন্তু এই সুপার কম্পিউটারটার কুলিং সিস্টেমটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, সুপার কম্পিউটার কি কোনো কাজ করবে? কাজ করবে না। তো এই যে ব্রেন! এই ব্রেন হচ্ছে একটা সুপার সুপার সুপার কম্পিউটার। আর মেডিটেশন হচ্ছে এটার কুলিং সিস্টেম। এটার কুলিং সিস্টেমটাকে সচল রেখে মস্তিস্ককে ঠান্ডা রাখে মেডিটেশন।