নৈতিক শিক্ষা সন্তানের জন্যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

নৈতিক শিক্ষা সন্তানের জন্যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

বাবা-মায়ের জন্যে স্রষ্টার দেয়া শ্রেষ্ঠ আমানত হচ্ছে সন্তান। একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে, বাড়িতে তখন আনন্দের বন্যা। শুধু মা-বাবা নন, এ আনন্দ সবার। কোনো মা-বাবার কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়, আপনার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় ঘটনা বা স্মৃতি কোনটি? ব্যতিক্রম দুয়েকজন বাদে সবাই বলেন, আমার সন্তানের জন্মমুহূর্ত। এই যে আনন্দের উপলক্ষ, যাকে তারা নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসেন, সেই প্রিয় সন্তানের সুন্দর, সফল, আলোকিত জীবন তারা চান। সেই চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অন্যতম সহায়ক হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা ।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এখনকার মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীরাও শিশুকে ছোটবেলা থেকে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার গুরুত্ব দিচ্ছেন। আমরা আজকের আলোচনায় দেখব যে, নৈতিক শিক্ষা কী এবং আমরা আমাদের সন্তানদের কীভাবে নৈতিক শিক্ষা দিতে পারি।

তার আগে একটি ঘটনা। ঘটনাটি বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ মরতুজা চৌধুরী স্যারের চেম্বারে ক্ষণিক দেখা জীবনের চিত্রলেখা বইটিতে ৭০ নম্বর পৃষ্ঠার রয়েছে। স্যার একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। তার চেম্বারে প্রতিদিন অসংখ্য শিশু আসে তাদের মা-বাবার সাথে। একদিন এক বাবা ঢুকলেন, কিন্তু তার সাথে কোনো বাচ্চা নেই। ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। তার দশ বছর বয়সী ছেলে তিন দিন আগে স্কুলে যাবার নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসে নি। যাওয়ার সময় সে মায়ের ব্যাগ থেকে ২০০ টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে। অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে সে তার নানা বাড়িতে চলে গেছে। তার টাকা চুরির অভ্যাসটা অনেক দিনের পুরনো। যখন তাকে পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি করা হয় তখন থেকে একটু হাতটানের অভ্যাস শুরু হয়। সে সহপাঠীদের পেন্সিল বা রাবার চুরি করে নিয়ে আসত। তার মা-বাবা মালিকের অনুমতি ছাড়া সামান্য পেন্সিল বা রাবার আনাকে সহজভাবে মেনে নিতেন। অন্যের জিনিস তার অনুমতি না নিয়ে নেয়াও যে একটি অপরাধ তারা তাকে তা বোঝান নি। ছেলে তার সহপাঠীদের জিনিস এনে মা-কে দেখিয়েছে, মা কোনো মন্তব্য করেন নি, রাগ করেন নি। ধরে নিয়েছেন যে, আদরের ছেলে খেলাচ্ছলে সহপাঠীর একটা পেন্সিল নিয়েছে এটা এমন কিছু না। বয়স হলে সব এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে। যেহেতু মা বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন তাই সন্তানও প্রতিদিনই সহপাঠীদের বিভিন্ন জিনিস চুরি করে আনা শুরু করে। তারপর মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করতে শুরু করে। চুরি করা তার অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়। একসময় সহপাঠীরা জেনে গেলে সবাই তাকে চোর বলে ডাকা শুরু করে। অনেক টিটকারী গালাগালি ও শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। কিন্তু চুরির যে অভ্যাস তার মধ্যে তৈরি হয়েছে সেটা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারে না। শেষমেশ সে মায়ের ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে নানা বাড়িতে চলে যায়। যাওয়ার সময় বাবাকে লিখে যায় যে, তার চুরি করার অভ্যাসটা যেন তার ছোট ভাইবোনের মধ্যে সংক্রমিত হতে না পারে এই ভয়ে সে নানার বাড়িতে চলে যাচ্ছে।

আসলে আজ পরিবারে, সমাজে যে অশান্তি, অবক্ষয়, যে বিপর্যয়, নির্যাতন, যে অসম্মান-এর কারণ হিসেবে বলা যায়, যে শিশুটি বেড়ে উঠছে, সঠিক নৈতিক শিক্ষাটি সে পাচ্ছে না। অভিভাবকগন সব ধরনের কষ্ট, পরিশ্রম, ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, তারা অনেক কষ্ট করছেন, অনেক পরিশ্রম করে সন্তানদের জন্যে অর্থ উপার্জন করছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল তারা পাচ্ছেন না। সন্তান ‘মানুষ’ হচ্ছে না। সমাজ নির্মাণকারী না হয়ে সমাজ ধ্বংসকারী হচ্ছে। পথভ্রষ্ট হচ্ছে, মাদকাসক্ত হচ্ছে। বন্ধু অপর বন্ধুকে, সন্তান মা-বাবাকে, মা-বাবা সন্তানকে হত্যা করছে এমন ঘটনাই ঘটছে। কারণ নৈতিক শিক্ষার প্রকৃত ধারণা থেকে আমাদেরকে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কীভাবে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তা একটু পরে বলছি। তার আগে একটু দেখি যে নৈতিক শিক্ষা বলতে আমরা কী বুঝি?

যে শিক্ষা জীবনকে আলোকিত করে। কোনটা মঙ্গল আর কোনটা অমঙ্গল তার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। কী করা উচিত আর কী থেকে বিরত থাকা উচিত তা বলে দেয়, সেটাই তো নৈতিক শিক্ষা। যে শিক্ষা সৎ থাকতে বলে, সত্য বলতে বলে, মিথ্যা বলতে বাধা দেয় সেটাই নৈতিক শিক্ষা। যে শিক্ষা অন্যের ক্ষতি নয় বরং যতটা উপকার করা যায়, তা শেখায়। নৈতিক শিক্ষা আমাদের মহানুভবতা, মানবিকতা ও ক্ষমার গুণকে বিকশিত করে। যখন একজন মানুষের হৃদয়ে নৈতিক শিক্ষা থাকে তখন সে শুধু নিজের জন্যে ভাবতে পারে না, সে ভাবে চারপাশের সবার কথা। সে জানে যে আত্মকেন্দ্রিকতায় কোনো সুখ নাই। সুখ হচ্ছে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার মধ্যে। নৈতিক শিক্ষা অন্যকে বিচার করে না, বোঝার চেষ্টা করে। নৈতিক শিক্ষা অন্যের কল্যাণে মমতাকে বিকশিত করে। এককথায়, একজন মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে তার ব্যাপারে যখন সবাই মনের অজান্তেই বলে উঠেন বড় ভালো মানুষ ছিলেন, এটাই প্রমাণ করে মানুষটি নৈতিকতায় কত উচ্চে ছিলেন। 

আমরা বাংলার দানবীর হাজী মুহাম্মদ মহসীনের কথা জানি। ১৭৭০ সালে ইংরেজরা যখন আমাদের দেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল সেই মহাদুর্ভিক্ষে তিনি অনেক লঙ্গরখানা খোলেন অভুক্ত মানুষের খাবারের জন্যে। পরিচিতরা বলেছিল, এ কী করছেন আপনি? আপনার সব সম্পদ তো শেষ হয়ে যাবে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমার সম্পদ থাকতে যদি আমার দেশের মানুষ না খেয়ে মারা যায়, এমন সম্পদের ওপর আল্লাহর লানত পড়ুক। তার বিপুল অর্থসম্পদ তিনি ব্যয় করেছেন বাংলার অনগ্রসর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারে। তার শিক্ষার ফান্ড থেকে এখনো ছাত্রছাত্রীরা বৃত্তি পায়। বঞ্চিত ও অভাবী মানুষদের সাহায্য করে আজও অমর হয়ে আছেন। আসলে নৈতিক জ্ঞানের জাগৃতি ঘটলে মানুষ ক্ষুদ্র চিন্তা বাদ দিয়ে সবাইকে নিয়ে ভাবতে পারে। তখন একজন মানুষ আমি’র পরিবর্তে ‘আমরা’–কে নিয়ে চিন্তা করে। সেই নৈতিক জ্ঞানকেই আমরা আমাদের সমাজে ফিরে পেতে চাই। 

একসময় আমাদের শিশুদের পাঠ্য আরম্ভ হতো নীতিবাক্য অনুশীলনের মাধ্যমে। শিশুদের আগে পড়ানো হতো-‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনো মিথ্যা বলিবে না, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিবে’ ইত্যাদি। আসলে সৎভাবে জীবনযাপন যে শ্রেয় এ বিষয়টি আমরা আত্মস্থ করতাম একেবারে ছোটবেলা থেকে। ফলে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি আমাদের আগ্রহ গড়ে উঠত সহজাতভাবে। যা কিছু অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণকর তা থেকে দূরে থাকার মানসিকতা তৈরি হতো।

আমাদের এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতির মূল কারণ কী? মূল কারণ হচ্ছে বৃটিশরা আমাদের দেশে ২০০ বছর রাজত্ব করেছে। রাজত্ব করার পরও যখন দেখল যে আমাদেরকে দাস বানাতে পারছে না তখন তাদের লক্ষ্য ছিল আমাদের নৈতিকতাকে ভেঙে দেয়া। যে কারণে ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড ম্যাকলে আমাদের এখনকার শিক্ষা নীতির প্রবর্তনে কাজ করেন। বৃটিশ পার্লামেন্টে লর্ড ম্যাকলে একটা বক্তৃতা করেছিলেন। সেটার একটা অংশ বাংলা অনুবাদ এরকম-

আমি ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করেছি, কোনো ভিক্ষুক বা কোনো চোর আমার চোখে পড়ে নাই। এই দেশে এত সম্পদ, এত উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ, এত গুণী মানুষ আমার মনে হয় না আমরা এই দেশকে জয় করতে পারব। যদি না আমরা এই জাতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দিতে পারি। আর এই মেরুদণ্ড হচ্ছে এদের আত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তাই আমি পার্লামেন্টে প্রস্তাব করছি এদের চিরায়ত শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির বদলে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার চালু করার। কারণ যদি ভারতীয়রা মনে করে যে যা কিছু বিদেশি ও ইংলিশ তা তাদের চেয়ে ভালো বা মহৎ তাহলেই তারা তাদের আত্মসম্মানবোধ হারাবে, হারাবে নিজস্ব সংস্কৃতি। তাহলেই আমরা তাদেরকে যেভাবে দেখতে চাই তেমনি সত্যিকার পরাধীন জাতিতে রূপান্তরিত হবে।

আর এ কারণেই সততার নীতিকথা পাঠের পরিবর্তে তারা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে যে, পাঁচ সের দুধের সাথে দুই সের পানি মেশালে বিক্রেতার কত লাভ হবে? ইংলিশ রাইমে শিখছে শিশু- Johnny Johnny/ yes papa/ Eating sugar?/ no papa/ telling lies?/ no papa/ open your mouth!/ HA HA HA. এই যে হা হা করে হাসি এটা বাবা ছেলের দুষ্টুমিকে প্রশ্রয় দিয়ে হেসেছেন না জনি হেসেছে বাবাকে বোকা বানাতে পেরে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু তো বুঝতে পারছি যে, জনি মুখে চিনি রেখেও বলছে যে, সে খাচ্ছে না। বাবা যখন বলছেন, মিথ্যা বলছ তুমি, তখনো সে বলছে, নো পাপা। এটা কি মহামিথ্যা নয়? 

একটা জাতির মূল শক্তি হচ্ছে তার নৈতিক শক্তি। আর সেই নৈতিক শক্তিকে ধরে রাখার জন্যে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা, প্রয়োজন নিজেকে সম্মান করা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করা। আমাদের সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনের মাধ্যমে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে কালের বিবর্তনে আমরা আমাদের নৈতিক সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছি। আমরা বাচ্চাদেরকে টিভি, সিনেমা দেখতে দিচ্ছি। তারা দেখছে ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান, নিনজাটারটল, টম এ্যান্ড জেরি, ডোরিমন। আর এগুলো দেখে তারা মনে করছে এটাই জীবন। এরাই মডেল। নিজের পরিবার নিয়ে ভাবার দরকার নেই। আশপাশের মানুষকে নিয়ে ভাবার দরকার নেই। ভাবতে হবে শুধু টিভি নিয়ে, টিভিতে যে নাটক হচ্ছে তা নিয়ে। নাটকের চরিত্র নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়, পরদিন আবার ক্লান্তি নিয়ে দৌঁড়াও, কাজ করো-এটাই জীবন। 

আমরা জানি, পরিবার শিশুর প্রথম পাঠশালা। আর মা-বাবা হচ্ছেন প্রথম শিক্ষাগুরু। তাই প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব মা-বাবারই। মা-বাবা সন্তানের আদর্শ। তাদেরকে সন্তানেরা অনুকরণ করে, অনুসরণ করে। দুই বছরের ছেলে শিশুটি বাবার পায়ের জুতোর মধ্যে ছোট্ট দুটি পা গলিয়ে বাবা সাজে, বাবার মতোই অফিসে যাওয়ার অভিনয় করে। অবচেতনে বাবা হয়ে যায়। একইভাবে কন্যাশিশুও একটা ওড়নাকেই হয়তো শাড়ি বানিয়ে পরে ফেলে। মা কীভাবে কাজ করেন, সেটা অনুসরণ করে বলবে, দেখ আমি মা হয়েছি না! মা-বাবার বই পড়ার অভ্যাস থাকলে সে-ও বই হয়তো উল্টো ধরেই বসে–তবুও বই হাতে নেবে, আর যদি দেখে তারা মিথ্যা বলছে, এই শিশু অবলীলায় মিথ্যা বলবে। মা-বাবা যদি বলেন, মিথ্যা বলা মহাপাপ–কোনো লাভ নেই। কারণ সন্তানেরা মা-বাবাকে যা করতে দেখে সেটাই করে, তারা যা করতে বলেন তা করে না। 

সাধারণভাবে মা-বাবারা মনে করেন, বাচ্চা ছোট, এখন ও কী বুঝবে! বড় হতে থাকুক, আস্তে আস্তে শিখবে। বিজ্ঞানীদের মতে, জন্মের পর থেকেই তার শেখার সুন্দর সময়। কারণ তখন একটু একটু করে শিশুর মস্তিষ্ক পরিপূর্ণতা লাভ করতে থাকে। অতএব এই সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময় তাকে পর্যাপ্ত সময় ও পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে।

প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যে সেসব ভালো গুণ দেখতে চাই সেগুলো আগে নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে। সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় আলোকিত করতে হলে আগে নিজে আলোকিত হতে হবে। সন্তান যখন বাবা-মায়ের মধ্যে শৃঙ্খলা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সমমর্মিতা, সদাচরণ দেখবে তখন তাদেরকে শেখানোর জন্যে আলাদা সময় ব্যয় করতে হবে না। আপনি যখন দান করছেন, তার হাতেও দিন। আপনি কোরআন পড়ুন, তাকেও পাশে বসিয়ে নিন। নামাজ পড়ছেন, পূজা-অর্চনা করছেন, সাথে নিয়ে নিন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে এসব চর্চার মাধ্যমেই নৈতিকতার শিক্ষা নিয়ে বড় হতে থাকবে। প্রত্যেক সন্তানকে কোরআনের মর্মবাণী, হাদীসের মর্মবাণী, নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের মর্মবাণী উপহার দিন একেবারে ছোট বয়সেই। এটি হবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। সে যখন পড়তে শিখবে, একটু একটু করে পড়বে। সে জানবে তার জীবনে কী করণীয়, কী বর্জনীয়। সে ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখবে। 

সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দানকালে দৃষ্টিভঙ্গি হবে মমতা ও সহনশীলতার। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। গল্পে গল্পে নৈতিকতার জ্ঞান তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। কাটকাট করে কথা বলে নয়। যেমন ধরুন, সিংহ ও ইঁদুরের সেই চিরায়ত গল্পে আমরা পড়েছিলাম যে, সিংহ যখন ইঁদুরকে খেতে নিল, তখন সে মিনতি করে বলেছিল যে, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার উপকারে আসতেও পারি। তারপর একদিন শিকারির জালে আটকা পড়লে সিংহকে জাল কেটে উদ্ধার করল ইঁদুর। সন্তানকে যদি শিক্ষা দিতে চাই যে, কাউকে কথা দিলে তা রাখতে হয়, তাহলে এই গল্পের মাধ্যমেও হতে পারে। 

আসলে ধর্মগ্রন্থ হলো তার নৈতিক শিক্ষার প্রথম আকর। তারপরে রয়েছে ইতিবাচক গল্প, ছড়া, কবিতা। আমি হবো সকাল বেলার পাখি, সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি-অসাধারণ কিছু ছড়া। আবার কিছু কিছু ছড়া আগে আমরা জানতাম একরকম, এখন সেগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন কেউ কেউ। তাতে সেগুলোও হয়ে যাচ্ছে ইতিবাচক। ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমী বইমেলায় একটি শিশুতোষ প্রকাশনার স্টল থেকে ভেসে আসছিল গানের সুরে-তাই তাই তাই / মামা বাড়ি যাই/ মামী দিলেন দুধ-ভাত/ পেট ভরে খাই/ মামা এলেন ছিপ নিয়ে/ মাছ ধরতে যাই। আগের ছড়ায় বেচারা মামীর প্রতি যে বিদ্বেষ ছিল, সেটা এখন দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা দোয়া করি, এরকম উদ্যোগ যেন আরো নেয়া হয়। 

আসলে শিশুর তো সরল মন, একে কলুষিত করা মোটেও কাম্য নয়। কারো মন্দটা তাকে বলে বলে তার সরল মনটা বিষিয়ে তোলা ঠিক নয়। ভালো কিছু বললে, সে ভালো ভাববে। আর ভালো ভালো ভাবলে, ভালো হবেই। উদাহরণ দিয়ে, বুঝিয়ে বলে তাদের শেখানো যেতে পারে। মহামানবদের জীবনের নৈতিকতার গল্পগুলো তাকে শোনানো যেতে পারে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সুবচন ও শিষ্টাচার কণিকা এবং শুদ্ধাচার বইটি তাকে পড়ে শোনানো যেতে পারে। শিশুকে বাঘ, কুকুর বা দৈত্য-দানবের ভয় দেখাবেনো মোটেও ঠিক নয়। শিশু বয়সে বিরাটকায় দৈত্য-দানব কল্পনা করতে করতে যখন স্কুলে যাবে টিচারকে দেখে ভয় পাবে, সহপাঠীকে দেখে কুঁকড়ে যাবে, পরীক্ষাকে ভাববে যুযু, ভাইভা বোর্ডকে ভাববে ফাঁসির মঞ্চ, তারপর চাকরি করতে গেলে বসকে দেখে কাঁপবে দুই পা। কারণ, ভয় যে তার মনে ঘাপটি মেরে আছে। ভয়ের কোনো আকার নেই, সে সবসময় অন্য ব্যক্তি বা বস্তুর ওপর ভর করেই ভয় দেখাতে আসে। 

শিশুকে রূপকথাও শোনানো ঠিক নয়। ধরুন, যে রূপকথায় আছে চেরাগ ঘষলে দৈত্য এসে সব করে দেয়। বাস্তবে সে যখন চেরাগ পাবে না, তখন খুঁজবে কে কে তার কাজ করে দিতে পারে। মা বলে হাঁক ছাড়বে, আর মা-কে বা গৃহকর্মীকে পানির গ্লাস নিয়ে ছুটে আসতে হবে। নিজের কাজ নিজে করার ক্ষেত্রে এই যে মানসিক পঙ্গুত্ব, এটা শারীরিক পঙ্গুত্বের চেয়েও মারাত্মক। সন্তানকে সময় দিতে হবে। সন্তানের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। সে তার কথাগুলো আপনাকে বলতে না পারলে তখন সে বাইরের বন্ধু খুঁজে নেবে, মাদকাসক্ত হবে, কিশোর গ্যাং এ যুক্ত হবে, টিকটক বেবী হবে, পথভ্রষ্ট হবে। তাই সন্তানকে সময় দিতে হবে। বন্ধু হতে হবে। দিনে একবেলার খাবার একসাথে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সুযোগ করে পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বেড়াতে যেতে হবে। তাহলে বায়বীয় জগতের আকর্ষণ থেকেও তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তার সামনে যদি খারাপ পরিস্থিতি আসে, অসৎ সঙ্গ যদি তাকে বিভ্রান্ত করতে চায়; তার বিবেক, তার নৈতিক মনোবল তাকে রক্ষা করবে। আসলে খারাপের মধ্যে ভালো থাকতে পারা, নিজেকে সঠিক পথে ধরে রাখতে পারা-এটা একটা বিরাট শক্তি। মমতার সাথে সন্তানকে দেয়া নৈতিক শিক্ষাই তাকে দেবে এই নৈতিক শক্তি। এই সন্তানেরাই সমাজকে, দেশকে, পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেবে। যে মানবিক মহাসমাজ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখছি তা পূরণ করবে। আমাদের প্রার্থনা হবে সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে, যেন চলে আলোকিত পথে। আর সে জন্যে সন্তানের জন্যে মসৃন পথ তৈরী দেয়ার পরিবর্তে, সন্তানকে পথের জন্য দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে হবে। সন্তানকে নৈতিক শিক্ষাদান হতে পারে সে পথে চলার অন্যতম অনুষঙ্গ।

2 thoughts on “নৈতিক শিক্ষা সন্তানের জন্যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *