মেডিটেশন বা ধ্যান কী? সাফল্য ও প্রশান্তির পেছনে ধ্যানের প্রভাব কতটুকু?

মেডিটেশন বা ধ্যান কী? সাফল্য ও প্রশান্তির পেছনে ধ্যানের প্রভাব কতটুকু?

আসলে মেডিটেশন কিন্তু অলৌকিক কিছু নয়। পুরোটাই বিজ্ঞান। অলৌকিক এবং বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? অলৌকিক জিনিসকে রিপিট করা যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানকে রিপিট করা যায়। যতবার খুশি, যত বেশি। এটা হচ্ছে বিজ্ঞানের বিশেষত্ব। বিজ্ঞানের যে-কোনো এক্সপেরিমেন্টকে রিপিট করা যায়। যে-কারণে যে-কেউ মেডিটেশন করতে পারেন। সাঁতার কাটলে যেমন হাতের পেশী মজবুত হয়, হাঁটলে যেমন পায়ের পেশী দৃঢ় হয়, মেডিটেশন বা ধ্যান চর্চা করলে তেমনই মস্তিস্ক সুগঠিত হয়, মস্তিকের কর্মকাঠামো উন্নত হয়। তাই মেডিটেশন হচ্ছে মূলত মস্তিস্কের ব্যয়াম। মেডিটেশন বলি, মোরাকাবা বলি, ধ্যান বলি একই জিনিস। ইংরেজিতে মেডিটেশন, বাংলায় ধ্যান, আরবি-ফারসিতে মোরাকাবা-মোশাহেদা। একই জিনিস। প্রক্রিয়াগত কিছু কিছু পার্থক্য আছে। কিন্তু মূল জিনিসটা এক।

গত ২২ জানুয়ারি ২০২১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোভিড-১৯ বিবেচনায় জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণ নির্দেশনা আসে একটি প্রজ্ঞাপনে। সেখানে স্কুল খোলার পরে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক কার্যক্রমের কিছু উদাহরণ বলা হয়েছে। প্রথম হচ্ছে খেলাধুলা। দুই নম্বর হচ্ছে মেডিটেশন। তিন নম্বর হচ্ছে যোগব্যায়াম। চার নম্বর হচ্ছে গাছ লাগানো। তারপরে হচ্ছে সংগীত চর্চা, ছবি আঁকা, তারপরে শেষ পয়েন্ট হচ্ছে সামাজিক সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ। দেখুন, স্কুলে স্কুলে মেডিটেশন শেখানো এ তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে এসেছে।

আসলে সত্যিকারের জ্ঞানের পথ হচ্ছে ধ্যান। একজন মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত স্থির না হচ্ছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আত্মনিমগ্ন না হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যথার্থ জ্ঞানী হতে পারেন না। মানুষকে যত কিছু দান করেছেন তিনি তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দান হচ্ছে জ্ঞান। তবে শুধু জ্ঞান নয়, স্রষ্টা আমাদেরকে আরো অনেক কিছু দান করেছেন। আমাদের জীবন দান করেছেন। জীবনের সকল আনন্দ দান করেছেন। এবং স্রষ্টার সব দান প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোথায় ছড়িয়ে আছে তা চোখ মেলে দেখতে হয়, কান পেতে শুনতে হয় এবং তারপর সংগ্রহ করতে হয়। এবং সেগুলো নিয়ে জীবনকে সুন্দর করার কাজে ব্যবহার করতে হয়।

কে পারেন এ কাজটি? যিনি প্রশান্ত, যিনি স্থির, যিনি নিমগ্ন। কারণ তিনি শুনতে পান, দেখতে পান এবং সময়মতো তা কাজে লাগিয়ে সুখ সৃষ্টি করতে পারেন তার জীবনে। আর যিনি অস্থিরচিত্ত, যিনি অশান্ত তিনি সবকিছুর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, নয়ছয় করে জীবনকে অসুখী করে তোলেন। অর্থাৎ সুখের প্রাচুর্য সৃষ্টি হয় জীবনে স্থিরতা এলে আর সুখের অভাব সৃষ্টি হয় জীবনে অস্থিরতার প্রভাবের কারণে। যিনি প্রশান্ত তিনি জীবনকে, জীবনের সমস্যাকে, জীবনের সংকটকে কাটিয়ে ওঠেন আস্থার সাথে, কুশলতার সাথে। এখানেই মেডিটেশনের গুরুত্ব।

মেডিটেশন কী করতে পারে তা বিশ্ববাসী দেখেছেন ২০১৮ সালের জুন মাসে। কোনো প্রতিকূলতায় মুষড়ে পড়া নয়, তা অতিক্রমে প্রয়োজন ঠান্ডা মাথায় ও প্রশান্ত মনে নিরলস প্রয়াস। আর এজন্যে ধ্যান বা মেডিটেশন কী করতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি থাইল্যান্ডের সেই ঘটনার মাধ্যমে।

একাপল চ্যান্থাওং থাইল্যান্ডে এক পাহাড়ের গুহায় ১২ জন কিশোর ফুটবলারসহ আটকে পড়েছিলেন আড়াই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। তারা বেড়াতে গিয়েছিলেন সেখানে। গুহার ভেতরে ঢোকার পরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। তারা গুহার আরেকটু ভেতরে ঢুকলেন। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে পানি জমে গুহার প্রবেশ পথ আটকে গেল। একাপল সেই কিশোরদের নিয়ে আশ্রয় নিলেন একটা পাথরের ওপর। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এমন অবস্থা থেকে আবার জীবনের পথে ফিরে আসার যে আশা ও বিশ্বাস তিনি ১২টি কিশোরের মাঝে সঞ্চারিত করেছিলেন সেটাই ছিল সবচেয়ে বিস্ময়ের।

একাপল ছিলেন একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু, পরবর্তীতে হয়েছেন ফুটবলের কোচ। কোচ হিসেবে তিনি ছাত্রদের দিতে চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চটুকু। অন্ধকার গুহা থেকে কিশোরদের উদ্ধার করার পর ডুবুরিরা সাক্ষ্য দিয়েছেন কিশোরদের বাঁচাতে কোচ একাপল নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। চারপাশে ময়লা পানি, শুধু পাথরের দেয়াল চুইয়ে যে পানি পড়ছিল, জিভ দিয়ে তা যতটুকু পান করা যায়। একজনের জন্মদিন উপলক্ষে তাদের ঘুরতে আসা, তাই সাথে খাবার ছিল সামান্য। সেটুকুই সবাইকে প্রতিদিন একটু একটু করে ভাগ করে দিয়েছেন। আর একাপল নিজে বেঁচে থেকেছেন পাহাড়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়া পানি পান করে। একাপল আজ সারাবিশ্বেই সমমর্মিতার এক অনন্য উদাহরণ। অন্ধকার গুহায় শুধু খেয়াল রাখাই নয়, ধ্যানের শিক্ষাও দিয়েছেন কিশোরদের, যা তাদের বিশ্বাসকে বলীয়ান করেছে। মনোবল ধরে রাখার জন্যে তিনি কিশোরদের মেডিটেশন চর্চা করিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে এসব কোনোকিছুই কারো অজানা নয়।

একজন ধ্যানী যখন প্রশান্ত থাকেন তখন তিনি যে-কোনো সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে পান। শুধু খুঁজে পান তা নয়, কোনো ক্ষত ছাড়াই সেখান থেকে বের হয়ে এসে স্বাভাবিকভাবে আবার জীবনের পথে হাঁটতে শুরু করেন। যে কারণে আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি যে, কিশোররা যখন বের হয়ে এলো গুহা থেকে, তাদের কারো মাঝে কোনো ট্রমা কাজ করে নি, কোনো ধরনের আতঙ্ক তাদের দুঃস্বপ্নের কারণ হয় নি। বরং তারা মজাদার খাবারদাবার রান্না করে দিতে মায়েদের কাছে বায়না করেছে, স্কুলের হোমওয়ার্কের কথাও তাদের মনে ছিল। এক কিশোর তার অভিভাবকের উদ্দেশ্যে গুহা থেকে লিখেছিল যে, ফিরে আসার পরে যেন হোমওয়ার্কের জন্যে বেশি চাপ দেয়া না হয়। মানে মাথা কতটা ঠান্ডা থাকলে পাঠ্যবই থেকে দূরে থাকার জন্যে এরকম কমিটমেন্ট আদায়ের চেষ্টা করতে পারে একজন কিশোর, ঐ অন্ধকার গুহায় বসে, তা আমরা বুঝতে পারছি।

প্রকৃতির মাঝে ধ্যানরত

আসলে জীবনের পথে চলতে চলতে সমস্যা আসবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে। এমন কোনো জীবন আমাদের কারো নেই যে জীবনে কোনো সমস্যা নেই, বাধা নেই, কষ্ট নেই। আসলে জীবন যতদিন আছে সমস্যা থাকবে। কিন্তু মনে প্রশান্তি থাকলে, মাথা ঠান্ডা থাকলে প্রতিটি পরিস্থিতি আস্থার সাথে, সাহসের সাথে, কুশলতার সাথে মোকাবেলা করা যাবে। মুক্তির পথ পাওয়া যাবে। কারণ অস্থিরতা আমাদেরকে বন্দি করে আর প্রশান্তি মুক্তির ডানা মেলে উড়তে সাহায্য করে। একটি পাখির ঘটনা বলি।

হযরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দী একদিন তার অনুগামীদের নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। সেই সময় একটি পাখি ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। আর বেরুতে পারছে না। একবার এই দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে, আরেকবার ওই দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খাচ্ছে। এর মধ্যে পাখিটাকে সাহায্য করার জন্যে যেই একজন অনুগামী উঠতে নেবেন, ওমনি হযরত বাহাউদ্দীন বললেন,‘থাক। বসে থাকো। তো পাখিটা ছটফট করতে করতে একসময় জানালার পাশে, একটা কলিঙ্গের পাশে গিয়ে বসে হাঁপাচ্ছে। যেই একটু ঠান্ডা হয়েছে, হযরত বাহাউদ্দীন একটা হাততালি দিলেন। চমকে উঠল পাখিটা, তাকালো একদিকে, দেখল বেরোনোর পথ, তারপর বেরিয়ে গেল। তখন হযরত বাহাউদ্দীন বললেন, ‘দেখ, যখন এ ছটফট করছে, ওড়াওড়ি করছে তুমি যত কিছু বোঝাতে চাও সে বুঝবে না। যখন সে শান্ত হলো, নীরব হলো, তখন আমার হাততালিতে সে চমকে উঠল ঠিকই; কিন্তু চমকে উঠেই সে নতুন সত্য উপলব্ধি করেছে যে রাস্তা এইদিকে এবং তারপর সে বের হতে পেরেছে। অর্থাৎ মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়া যায় প্রশান্ত থাকলে পরে।

ধ্যান এর প্রথম প্রাপ্তিই হচ্ছে প্রশান্তি। ধ্যান বা মেডিটেশন কীভাবে আমাদেরকে প্রশান্তি দেয়-এ প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। সেটা এখন একটু পরিষ্কার করি। মেডিটেশন প্রথমত দেহের স্নায়ু ও পেশিকে শিথিল করে। দেহ ও মন যখন স্থির হয়, তখন রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-হিংসার মতো নেতিবাচক আবেগ কাজ করতে পারে না। এ ধরনের আবেগ এলে সাধারণত আমরা শান্ত থাকতে পারি না। আমরা ভুল করি। যেমন, আমরা যখন রেগে যাই, রেগে গিয়ে যে কাজটা করি সেটার জন্যে পরে আবার নিজে অনুশোচনা করি-আহা কাজটা তো ঠিক হলো না। তারপর সরি বলি, মাফ চাই। তার মানেটা কী? মনের নেতিবাচক আবেগ আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলছে। কিন্তু যখন মেডিটেশন নিয়মিত করি, তখন আমরা এই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

মেডিটেশন আমাদের মনটাকে বর্তমানে নিয়ে আসে। কারণ মন যদি অতীতে থাকে বা মন যদি ভবিষ্যতে থাকে, তাহলে অশান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ অতীতে ভালো কোনো ঘটনা মনে করার চেয়ে আমরা দুঃসহ স্মৃতিকেই প্রথমে মনে করতে থাকি। ফলে তা আমাদের মনে ক্ষয়ানুরণন সৃষ্টি করে। ইস্, উহ্, আহ্হা-এ জাতীয় শব্দ দিয়ে আমরা সেই ভয়াবহ অতীত হাতড়ে বেড়াই। আবার যখন ভবিষ্যতে মন থাকে, তখন প্রত্যাশার চেয়ে সাধারণত আশঙ্কাটাই মনে জানান দেয়। কাল্পনিক বিপদ মনের পর্দায় ভাসতে থাকে। আচ্ছা, আমি রাস্তা দিয়ে যাব যদি কোনো ছিনতাইকারী আক্রমণ করে? তাহলে কী হবে? আচ্ছা, টাকা-পয়সা নিয়ে গেল। আচ্ছা, যদি ছুরি মারে তাহলে কী হবে? আমি যদি আহত হয়ে যাই তাহলে কী হবে? মেডিটেশন যেহেতু মনকে বর্তমানে থাকতে সাহায্য করে, তাই অনুশোচনা, দুঃখ কিংবা আশঙ্কার কল্পনা কোনটাই পাত্তা পায় না। আমাদের মনটা তখন বর্তমান নিয়ে মনোযোগী থাকতে পারে, ফলে ব্রেন তখন কাজ করতে পারে দেহের স্বাস্থ্য উদ্ধারে, সম্ভাব্য সংকট নিরসনে এবং মেধার বিকাশে। কারণ মন যত প্রশান্ত থাকবে, ব্রেন তত ঠান্ডা থাকবে। আর মেডিটেশন হচ্ছে ব্রেনের কুলিং সিস্টেম আর মাইন্ডের ক্লিনিং সিস্টেম।

আসলে আমরা অনেক সময় বুঝি না। ধরুন আপনার একটা সুপার কম্পিউটার আছে। এবং ওখানে যে-কোনো ডাটা দেন মুহূর্তে প্রসেস করে আপনাকে সলিউশন দিয়ে দেবে। আপনাকে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেবে। কিন্তু এই সুপার কম্পিউটারটার কুলিং সিস্টেমটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, কুলিং সিস্টেমটা যদি কাজ না করে, সুপার কম্পিউটার কি কোনো কাজ করবে? কাজ করবে না। তো এই যে ব্রেন! এই ব্রেন হচ্ছে একটা সুপার সুপার সুপার কম্পিউটার। আর মেডিটেশন হচ্ছে এটার কুলিং সিস্টেম। ব্রেনের কুলিং সিস্টেমটাকে ঠিক রাখার জন্যেই মেডিটেশন দরকার। যাতে আপনি ব্রেনটাকে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে পারেন। সকালবেলা মেডিটেশন করে দিন শুরু করতে পারলে মাথা ঠান্ডা থাকবে, মনটা স্থির থাকবে।

একজন ধ্যানী শরীরিকভাবে অন্যদের চেয়ে বেশী সুস্থ থাকেন, মানসিকভাবে অনেক উজ্জীবিত ও উন্নত মানসিকতার অধিকারী হন, পারিবারীক ও সামাজিক ভাবে হয়ে উঠেন সকলের নির্ভতা ও আস্থার প্রতীক। ধ্যানীরা রাগ-ক্ষোভ-ঈর্ষা-হিংসা, গীবত সহ সকল নেতিবাচকে আবেগের উর্ধে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী।

প্রশান্তির সন্ধানে এখন হাজারো মানুষ নিয়মিত ধ্যান চর্চা করছে। একজন ধ্যানী শোকরগোজার হন। প্রশান্তি অনুভব করেন। ধ্যানীর জীবনে ব্যস্ততা আছে, হুলস্থুল নেই; সমস্যা আছে, কিন্তু সংকট নেই, রয়েছে সমাধানের পথ। অশান্তি নেই, রয়েছে প্রশান্ত প্রত্যয়। এই প্রশান্তি অন্য কেউ বা অন্য কোনো কিছুই দিতে পারবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *