দেহ-মনের টোটাল ফিটনেস এর জন্যে করণীয় কী?

দেহ-মনের টোটাল ফিটনেস এর জন্যে করণীয় কী?

টোটাল ফিটনেস এর জন্যে চাই প্রতিটি কাজ সঠিক সময়ে করা, সঠিক নিয়মে করা। আসলে সময়মতো সঠিক কাজটি করতে পারা প্রজ্ঞাবানদের বৈশিষ্ট্য। এবং এভাবে কোনো কাজ করতে পারলে কী হয়-এ নিয়ে একটি ঘটনা আছে। ঘটনাটি ইবনে সিনা-র মহান কর্মজীবনের। ইবনে সিনা শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না। তিনি একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, কবি, ধর্মতত্ত্ববিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষবিজ্ঞানী ছিলেন। তখনকার দিনে জ্ঞানের এমন কোনো শাখা ছিল না, যেখানে তার বিচরণ ছিল না। মেধা ও যোগ্যতার জন্যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন অল্প বয়সেই। অর্থ-প্রতিপত্তির ঊর্ধ্বে জ্ঞান অর্জনকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি।

আমরা যে ঘটনাটি বলতে চাচ্ছিলাম। ঘটনাটি শুনতে শুনতে মনে হবে এটা কি আসলেই ঘটেছিল? আসলেই ঘটেছিল। সত্যি। পারস্যের এক রাজকুমার। তার এক অদ্ভুত রোগ হলো। নিজেকে মানুষ নয়, মনে করত সে একটি গরু! গরুর মতো হাম্বা হাম্বা স্বরে ডাকাডাকিও করত। একপর্যায়ে খাওয়া-দাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। কেঁদে কেঁদে সে আর্জি জানাত, ‘আমাকে মারো, আমাকে জবাই করো, তোমরা আমার গোশত রান্না করে খাও। রাজকুমারের এই অবস্থা দেখে রাজা পড়লেন মহাবিপদে। কোন ডাক্তার-হেকিম করবে এ অদ্ভুত রোগের চিকিৎসা? রাজা সে-সময় পারস্যের প্রখ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনার শরণাপন্ন হলেন এবং পুত্রের জীবন রক্ষার অনুরোধ জানালেন। ইবনে সিনা চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন। বুঝতে পারলেন, এটি মনস্তাত্ত্বিক কোনো জটিলতা। তিনি রোগীর কাছে এক লোক পাঠিয়ে বললেন, রাজকুমারকে গিয়ে আশ্বস্ত করো তোমাকে জবাই করার জন্যে শিগগিরই কসাই আসবে। তুমি প্রস্তুত থেকো। এ কথা শোনার পর রাজকুমার মহাখুশি। ভাবখানা এমন যে, তার গরু হয়ে জন্মানোটা এবার সার্থক হতে যাচ্ছে! একসময় ইবনে সিনা একটি বড় ধারালো ছুরি হাতে হাজির হলেন। রাজপ্রাসাদে গিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন-আমার গরুটা কোথায়? আমি এখন তাকে জবাই করব। রাজকুমার গরুর মতো হাম্বা শব্দ করে জানান দিল-এই যে, গরু এখানে! ইবনে সিনার নির্দেশে সবাই তাকে ধরে শোয়াল। রোগীও আনন্দে শুয়ে পড়ল। ইবনে সিনা রাজকুমারের গলায় ছুরি ঠেকিয়ে বললেন যে,‘নাহ! এই গরুটা খুব হ্যাংলা পাতলা, এর গায়ে তো তেমন গোশতই নেই। জবাই করব না। একে খাওয়া-দাওয়া করাও। একটু মোটাতাজা হোক, তাহলে এর গোশত সুস্বাদু হবে। রোগীও ভাবল, তা-ই তো! এরপর রোগীকে যে খাবারই দেয়া হয়, তৃপ্তির সাথে সে খেতে শুরু করল। মোটাতাজা তাকে হতেই হবে। নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি রোগীর সাথে কাউন্সেলিং শুরু করলেন ইবনে সিনা। ধীরে ধীরে রোগী তার স্বাস্থ্য ফিরে পেল। মানসিক অবস্থার উন্নতি হলো তার। একসময় সুস্থ হয়ে উঠল রাজকুমার। দূর হলো মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা।

শরীর ও মনের সুস্থতা একটি আরেকটির সাথে খুব গভীরভাবে সম্পর্কিত। মনের প্রভাব যেমন শরীরে পড়ে, তেমনি শরীরের জন্যে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর খাবার কেন প্রয়োজন তাও আমরা মোটিমোটি কমবেশী জানি।

আসলে আমরা যা খাচ্ছি, সেই খাবারের প্রভাব আমাদের পেটে পড়ে এবং পেট থেকে আমাদের পুরো শরীরের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। কারণ বাস্তব সত্য হচ্ছে আমরা যা খাই তার নির্যাসের জৈবিক রূপ হচ্ছি আমরা। আমরা যা খাই ও পান করি আমরা আসলে তা-ই। আমাদের শারীরিক-মানসিক ভালো থাকা সরাসরি যুক্ত খাবার এবং পানীয়ের সাথে। আমরা যা খাই, সেখান থেকে যে পুষ্টি সংগৃহীত হয় সেটাই আমাদের কোষগুলোর মেমব্রেনস বোনম্যারো, রক্ত, হরমোন, টিস্যু, অঙ্গ, ত্বক, চুল-সবকিছুর গঠন প্রকৃতি নির্ধারণ করে। পেটে বসবাস করে কোটি কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া। আমরা যা খাবার খাই তা পেটে অবস্থিত ভালো এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যকে সরাসরি প্রভাবিত করে। স্ট্রেস-টেনশন, দূষণ এবং প্রসেসড ফুড প্রক্রিয়াজাত খাবার পেটের এই ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করে। এবং যখনই এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এমন রাসায়নিক উপাদান ছেড়ে দেয় যা প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং রোগাক্রান্ত করে।

তাই আমরা কী খাচ্ছি সেদিকে নজর রাখাটা আমাদের সুস্থ থাকার জন্যে প্রথম প্রয়োজন। যদি কেউ ফাস্টফুড খান, অস্বাস্থ্যকর খাবার খান, তামসিক খাবার খান, হারাম খাবার খান তাহলে অল্প বয়সে ব্যাধির আক্রমণে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারেন। কোনো ডাক্তার, কোনো হাসপাতাল তাকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারবে না যদি না তিনি খাবারের ক্ষেত্রে সুস্থ স্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ না করেন। আর যদি উপকারি খাবার খান, প্রাকৃতিক খাবার খান, তিনি সুস্থ থাকবেন। তার সুস্থ থাকা রোগমুক্ত থাকা দীর্ঘায়ু হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।

সামগ্রীক সুস্থতার জন্যে চাই টোটাল ফিটনেস। এই ফিটনেসের শুরুটা হচ্ছে ফিজিকেল ফিটনেস। আর ফিজিকেল ফিটনেসের জন্যে চাই খাবার-দাবারের ব্যাপারে সচেতনতা। কারণ পেট ফিট তো মাথা ফিট। আমাদের পরিপাকব্যবস্থা এককথায় পেট আমাদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে দারুণভাবে। সুষম খাবার, সাত্ত্বিক খাবার শুধু সুস্বাস্থ্য এবং জৈবিক প্রক্রিয়াকেই প্রভাবিত করে না। সুষম স্বাস্থ্যকর খাবার পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করলে তা আমাদের ভেতরে চমৎকার তৃপ্তির আনন্দ দিতে পারে। কারণ পেটের সাথে মস্তিষ্কের সংযুক্তি রয়েছে।

পারস্যের রাজপুত্রের গল্প বলতে বলতে আমরা খাদ্যসচেতনতার দিকে চলে এসেছি। তো সেই রাজা ইবনে সিনাকে ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা খুঁজে পান নি। কারণ ঐ সময়ে তিনি রাজপুত্রকে সুস্থ হওয়ার দাওয়াই না দিলে রাজার উত্তরসূরি নির্বাচনে বেগ পেতে হতো। সেই রাজপুত্রকেই তিনি পরবর্তী রাজা করার সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিলেন। তারপর যখন সে সুস্থ হলো, রাজা হওয়ার প্রশিক্ষণ তার শুরু হলো। আসলে লোহা গরম থাকতে থাকতেই তাকে শেপ দিতে হয়। চুলায় তাওয়া গরম থাকতে থাকতেই রুটি সেঁকতে হয়। তাহলেই তো রুটির সব দিক ফুলে উঠবে বেলুনের মতো। এখন আসলে এমন একটি সময়, যখন চারদিকে শারীরিক রোগ, মানসিক রোগ, সামাজিক রোগ আর আত্মিক বুভুক্ষা বিরাজ করছে। তাই এখন আমাদের একটাই লক্ষ্য-সার্বিকভাবে ফিট হওয়া।

এবারে তাহলে চলে আসি ছোট ছোট কিছু চর্চা যা করে আমরা টোটালি ফিট হওয়ার চেষ্টা করতে পারি। এই চর্চাগুলোকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে এলে দেখব যে, নিয়মিত চর্চা করাটা সহজ হচ্ছে।

প্রথমত, আমরা এবার প্রাকৃতিক খাদ্য সচেতনতা সৃষ্টি করব। রাজসিক-তামসিক খাদ্যাভ্যাস থেকে একটু একটু করে প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসে শিফটিং করতে হবে। কারণ শরীর নামক ভেলায় চড়েই আমাদের এই আত্মা পৃথিবী পরিভ্রমণ করছে। নৌকায় ফুটো হয়ে গেলে কি আর নদী পার হওয়া যাবে? নৌভ্রমণ বাদ দিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ঠিক একইভাবে জীবনের ভ্রমণকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে শরীরটাকে আগে ফিট রাখতে হবে। এজন্যেই চার ধরনের ফিটনেসের লক্ষ্যমাত্রায় শারীরিক ফিটনেস এক নম্বরে আছে। পরিমিত ঘুম, নিয়মিত যোগ ব্যয়াম ও মেডিটেশন চর্চা, বিজ্ঞান সম্মত খাদ্যাভাস, টেনশন মুক্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, শুদ্ধাচারী হওয়া ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করা টোটাল ফিটনেস অর্জনের অন্যতম উপাদান।

মানসিক ফিটনেসের জন্যে প্রাথমিকভাবে আমরা তিনটি মানদণ্ড অনুসণে করতে পারি। এক-প্রো-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি, দুই-শুকরিয়া এবং তিন-সমমর্মিতা। উত্তেজিত হওয়া, চ্যাচামেচি করা কিংবা বিবাদ-ফ্যাসাদ-ঝগড়া করা থেকে তো দূরে থাকার চেষ্টা করবই। আরো সাবধান হবো কারো প্রতি যেন কোনো বিদ্বেষ মনে না আসে। আসতে নিলেই তওবা তওবা পড়ব, ক্ষমা করো আল্লাহ জিকির করতে থাকব। যার কথাই মনে হবে তার জন্যে প্রথমেই যেন মনে দোয়া আসে। তার শুভকামনা যেন করতে পারি। আসুন, দেখি না, এবার সবচেয়ে অপছন্দের একজন মানুষকে মন থেকে ক্ষমা করে তার জন্যে দোয়া করতে পারি কিনা। ইনশাআল্লাহ দেখবেন যে, বাস্তবে তার সাথে দেখা হলে তিনি কত আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। সত্যি সত্যি যখন তিনি এগিয়ে আসবেন, আমরা যেন আন্তরিকভাবে তাকে সালাম দেই। শুধু তাকে নয়, যার সাথেই দেখা হবে হাসিমুখে সালাম দেয়া-এটা সামাজিক ফিটনেসের একটি মাত্রা। সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম ও সৎ সঙ্ঘে একাত্ব থাকাও শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেস অর্জনের জন্যে অত্যাবশ্যক। আত্মিক ফিটনেস বাড়ানোর জন্যে যতটা সময় পারি যেন ভালো কাজে, ভালো চিন্তায়, ভালো ভাবনায় আমরা একাত্ম থাকি। স্রষ্টা আমাকে দেখছেন, আমার সবকথা শুনছেন এ অনুভূতি যেন সবসময় স্বরণে থাকে। আমি যে কাজটি করছি বা যা ভাবছি তা স্রষ্টার পছন্দনীয় না অপছন্দনীয় সে বিষয়টি প্রতিটি কাজ ও চিন্তার পূর্বে নিজের বিবেককে প্রশ্নকরি। প্রভুর স্মরণে, নিজের ও মানুষের কল্যাণে যেন কাজ করি-প্রভু আমাদের সকল চেষ্টা কবুল করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *