পরিবার আসলে কী? পরিবারকে সময় কেন দেবো?

পরিবার আসলে কী? পরিবারকে সময় কেন দেবো?

পরিবার হচ্ছে সভ্যতার সূতিকাগার। একজন মানুষ প্রথম শিক্ষা পায় তার পরিবার থেকে। বলা হয়ে থাকে একটি শিশু সেটাই সবচেয়ে আগে গ্রহণ করে যা সে চারপাশে ঘটতে দেখে। আর একটা শিশুর চারপাশ কী? নিঃসন্দেহে তার পরিবার। আমরা স্কুলে সমাজবিজ্ঞান পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম বাবা-মা-ভাই-বোন-দাদা-দাদী-চাচা-চাচী-প্রমুখদের নিয়ে আমাদের পরিবার। আসলেও তাই। এটা হলো সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিবারের তাত্তি¡ক সংজ্ঞা। আর আমাদের কাছে পরিবার মানে হলো, যে ঘরে আমার জন্ম, যেখানে আমি শিশু থেকে বেড়ে উঠে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি, যে ছাদের নিচে থেকে পড়াশোনা করেছি, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম বিশ্রাম থেকে শুরু করে আমার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্ম এখনো করছি, সেখানে আমার সাথে যারা সহযাত্রীর মতো আছেন, তারা একসাথে মিলে হলো আমার পরিবার।

পারিবারিক জীবনে একটা ছোট্ট প্রশংসা বা অণুপ্রেরণা যে একজন মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে-ধরুন আপনি ভালো কোনো প্রোগ্রামে যাবেন, সেই প্রোগ্রামের জন্যে একটু পরিপাটি হয়ে সেজেছেন। পুরুষ হলে ভালো প্যান্ট শার্ট বা চমৎকার একটা পাঞ্জাবী অথবা মহিলা হয়ে থাকলে সুন্দর মানানসই সাজ পোশাক পড়ে তৈরি হয়েছেন। আপনার মা/ বাবা কিংবা আপনার স্বামী/ স্ত্রী অথবা হতে পারে আপনার চার/ পাঁচ বছর বয়সী ছোট্ট সন্তানটি আপনাকে দেখেই প্রশংসার দৃষ্টিতে উচ্ছ¡সিত হয়ে বললো ‘বাহ্… তোমাকে আজ কী যে সুন্দর লাগছে…’ আপনিই বলেন, ঐ দিনটি আপনার কেমন যাবে? আপনার কাছে কী মনে হবে না যে পুরো দিনটাই আজ কত না সুন্দর!

একইভাবে পরিবার যদি আপনার পক্ষে থাকে, আপনি অনেক অসাধ্যকে সাধন করতে পারবেন। এক তরুণ যিনি পেশায় একজন ডেন্টাল সার্জন, জানালেন তার সাফল্যের কথা। ডেন্টাল কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর কী করবেন চিন্তা করতে করতে খুব সাহস করে মাকে গিয়ে বললেন, ‘মা আমি আমাদের গ্রামের বাড়ির দিকে গিয়ে প্র্যাকটিস করতে চাই।” অর্থাৎ চেম্বার করে সেখানে তিনি চিকিৎসাসেবা দিতে চান। মা এই কথা শুনে স্বাভাবিকভাবেই বললেন, ‘তুই শহরের ছেলে, গ্রামে গিয়ে কী করবি? আর ওখানে তো তুই সেভাবে কাউকে চিনিসও না, চেম্বার জমাতে পারবি তো?’ তো ছেলে বললো, আমি আমাদের মফস্বলে যাই, দেখি কিছুদিন কী হয়। মা একটু ইতঃস্তত করলেও ছেলের উৎসাহ দেখে রাজি হলেন এবং দোয়া জানালেন। সেই ছেলে তার এলাকায় গিয়ে প্রথমে একটা ঔষধের দোকানে কিছুদিন দাঁত তোলার কাজ করলো, দুই তিন মাসে এলাকার লোকজনের সাথে পরিচয় হয়ে গেল, এলাকার লোকজন জানলো এখানে দাঁতের জন্যে পাশ করা ডাক্তার আছে, আর শহর ছেড়ে মফস্বলে আসায় সবার আন্তরিক সমমর্মিতা তো ছিলোই। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই সে নিজস্ব চেম্বার করলো এবং এক বছরের মাথায় ঐ এলাকায় প্রথম ডেন্টাল ক্লিনিক গড়ে তুললো। সেবার মান চমৎকার। সপ্তাহে একদিন ঢাকা থেকে তারই শিক্ষক, একজন প্রফেসর ঐ এলাকায় যান এবং একটু  বেশি সংকটাপন্ন রোগীদের সেবা দেন।

তো সেই তরুণ দন্ত চিকিৎসক বলছিলেন, তার যে বন্ধুরা কলেজ থেকে বের হয়েই ভালো বেতনে চাকরি নিয়েছে আর সে কি না মফস্বলে যাচ্ছে শুনে হাসাহাসি করেছিলো আজ তারাই তাকে নিয়ে গর্ব করে। তিনি বললেন, আসলে আমি যদি সেদিন ফ্যামিলির বিশেষত মায়ের সহযোগিতা ও দোয়া সেভাবে না পেতাম, চাকরি না করেই স্বাধীন পেশায় যাওয়ার মতো এত সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না।

পরিবারে সময় না দিলে কী হবে?

পরিবার ছাড়া যে মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হতে পারে তা পাশ্চাত্য সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। সেখানে নিয়মতান্ত্রিক পরিবার গঠনের অভাবে কারো জন্যে কোনো মায়া-মমতা নেই। কেউ কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। যার যেমন খুশি সে তেমনভাবে চলছে, যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যাচ্ছে। কেউ মারা গেলে তার জন্যে কান্না করারও কেউ কোত্থাও নেই। মানুষ আসলে একা থাকতে পারে না। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, রোগে-শোকে, হাসি-কান্নায়, সাফল্য-ব্যর্থতায়, জীবনে-মরণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিবার ছায়াসঙ্গীর মতো পাশে পাশে থাকে।

আবার অনেকেই আছেন যারা আসলে পরিবারে থেকেও নাই। সেটা আবার কেমন? স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিস থেকে এসেই বসে গেলাম টিভি নিয়ে। যতক্ষণ বাসায় আছি ক্রিকেট না হলে খবরের পর খবর, এই চ্যানেলের পর ঐ চ্যানেল। আর এখনতো কম বয়সী থেকে শুরু করে অনেকেই ব্যস্ত ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডশিপ তৈরিতে, না হলে ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোতে ব্যস্ত। ফলে এখন পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীর সাথে পরিচিত হতে বা নাম জিজ্ঞেস করতেও কেমন কেমন যেন লাগে। আবার আমাদের সমাজে এমন পরিবারও বহু আছে যেখানে বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহের কারণে সন্তানরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, ভুল লালনের কারণে সন্তান বখে গিয়ে ড্রাগসের আসক্তি তৈরি করছে। পারিবারিক অশান্তি বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে বিবাহ-বিচ্ছেদের হার। অনেক পরিবারেই অশান্তির আগুন জ্বলছে।

আসলে নিজের ও পরিবারে প্রশান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়ার জন্যেই পরিবারকে সময় দেয়া প্রয়োজন। অন্যে কে কী করলো সেদিকে না তাকিয়ে আপনি আপনার সাধ্যমতো করুন। পরিবারে আপনার গ্রহণযোগ্যতা অন্যরকম একটি মাত্রা লাভ করবে।

বলবেন, এত কাজে ব্যস্ত থাকি, অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়, সময় কীভাবে দেবো? আসলে একটু খেয়াল করলেই দেখবেন আমাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্যরা আসলে এত ভালো যে তারা কখনই খুব বেশি সময় চায় না। অল্প সময় হোক, কিন্তু তারা চান  পূর্ণ মনোযোগ। আপনি একজনের সাথে মাত্র পাঁচ মিনিট কথা বলেন, কিন্তু ঐ পাঁচ মিনিট যেন হয় কোয়ালিটিফুল। অর্থাৎ এই পাঁচ মিনিট আপনার সমগ্র মনোযোগ জুড়ে যেন শুধু তিনিই থাকেনÑআর কোনো কিছুই না। দেখবেন এই অল্প একটু সময়ের কথাই তিনি মনে রাখবেন, এই সময়টুকুর জন্যেই তিনি অপেক্ষা করবেন।

প্রতিদিন সুযোগ করে বাবা-মায়ের খোঁজখবর নিন। আন্তরিকভাবে তাদের পাশে গিয়ে বসুন, তাদের হাতে হাত রাখুন, মমতার পরশ বুলিয়ে দিন। সম্ভব হলে তাদের কিছু দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিন। তাদের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া পাবেন, আপনার চলার পথ অনেক মসৃন ও প্রশস্ত হয়ে যাবে। আর যাদের ছোট বাচ্চা আছে স্কুলে গিয়ে সে কী করে জানতে চান। বাচ্চার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন। আপনার সন্তানের তখন ঘরের বাইরে গিয়ে কিংবা ঘরে বসেই যন্ত্রের সামনে বসে অহেতুক অপ্রয়োজনীয় আনন্দ খোঁজার প্রবণতা কমে যাবে। নবীজী (স) বলেছেন, ‘সন্তানকে আদব শিক্ষা দেয়া ভিক্ষুককে অনেক ভিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম।’ – মেশকাত

দম্পতিদের ক্ষেত্রে, নিজের স্বামী বা স্ত্রীকে আলাদা করে কিছুটা সময় দিন। এই সময়টা শুধুই আপনাদের। টিভির মতো বোকা বাক্সের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে না থেকে ঘরের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করুন। পারস্পরিক একাত্মতা বাড়াতে কাজে আসবে। আজকের আলোচনার উপসংহার আমরা টানতে পারি নবীজী (স)-এর আরেকটি হাদীস দিয়ে, তিনি বলেছেন, ‘মানুষ হিসেবে তারাই উত্তম, যারা তাদের পরিবারের কাছে ভালো; যেমন আমি আমার পরিবারের কাছে ভালো।’- তিরমিজী। তাই মানুষ হিসেবে সবদিক থেকে ভালো হওয়ার জন্যে ও ভালো থাকার জন্যেই পরিবারকে সময় দিন। পড়াশোনা, চাকরি বা ব্যবসার পরের বাকি সময়টা অহেতুক আড্ডা বা গালগল্পে নষ্ট না করে পরিবারে, সৎকর্মে, সৎ চিন্তায় ও সৎসঙ্ঘে ব্যয় করুন। আপনার প্রশান্তি ও অগ্রগতি আপনাকেই মুগ্ধ করবে। পরম করুণাময় আমাদের সকলকে কবুল করুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *