একবার একটি বড় শহরে একজন ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। পুরো শহরে তার মতো সম্পদের মালিক আর দ্বিতীয় কেউ ছিল না। তার সম্পদের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, পুরো শহরের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি। এতে বেশ সুখেই কাটছিল তার দিনগুলো। কিন্তু একদিন তার মনে হলো পুরো শহরের অর্ধেক সম্পদের মালিক হলে তিনি হয়তো আরো বেশি সুখী হবেন। তাই তিনি সম্পদ বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করলেন। লক্ষ্য শহরের অর্ধেক সম্পদের মালিক হওয়া। মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে মাত্র এক দশকের মাথায় সফল হলেন তিনি। সত্যি সত্যি অর্ধেক শহরের মালিক হয়ে গেলেন।
এরপর তিনি চিন্তা করলেন, অর্ধেক শহর যেহেতু তার, বাকি অর্ধেক আর অন্যের থাকবে কেন? তাই শহরের বাকি অর্ধেকও নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। স্বপ্ন দেখে বসে থাকার লোক তিনি নন। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আবারও কঠোর পরিশ্রম শুরু করলেন। মাত্র দু-দশকের মাথায় একদিন সত্যি সত্যি পুরো শহরের মালিকও হয়ে গেলেন তিনি!
এবার তিনি চিন্তা করলেন অনেকতো পরিশ্রম হলো এবার পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে থাকতে পারলেই হলো। কিন্তু তার ঠিক কয়েক মুহূর্ত পর মৃত্যুদূত এসে হাজির হলো তার দরজায়। তার সময় শেষ এটা কিছুতেই মানতে পারলেন না তিনি। মনে মনে ভাবলেন সারাজীবন হাড়ভাঙা খাটুনি করে জমানো সম্পদের কিছু অংশ মৃত্যুদূতকে দিয়ে কিছুটা অতিরিক্ত সময় চেয়ে নেবেন। তিনি মৃত্যুদূতকে কিছু সম্পদের বিনিময়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। মৃত্যুদূত কিছুতেই সেই ধনী ব্যক্তির প্রস্তাবে রাজি হলো না। কারণ সে স্রষ্টার নির্দেশ পালনের জন্যে এসেছে। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলেও মৃত্যুদূত তার সিদ্ধান্তে অনড় রইল। তাই বাধ্য হয়ে একসময় সেই ধনী ব্যক্তি বললেন আমার সব সম্পদের বিনিময়ে হলেও আমাকে মাত্র একটি ঘণ্টা সময় দাও। আমি সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্য আরেকটু উপভোগ করতে চাই। আমার পরিবার আর বন্ধুদের সাথে আরেকটু সময় কাটাতে চাই।
আসলে এই বিশাল সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে বহুদিন তাদের মন ভরে দেখতে পর্যন্ত পারি নি। তাদের সাথে প্রাণভরে কথা বলি না বহুদিন। কিন্তু মৃত্যুর ফেরেশতা এই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিল। অবশেষে কোনো উপায় না পেয়ে সেই ধনী ব্যক্তি মৃত্যুদূতের কাছে এক মিনিট সময় চান, যেন তিনি সবার উদ্দেশ্যে একটি চিরকুট লিখে যেতে পারেন। মৃত্যুদূত তার শেষ অনুরোধ আর ফেলল না, সেই ধনী ব্যক্তিকে এক মিনিট সময় দেয়া হলো।
এই এক মিনিটে তিনি সবার উদ্দেশ্যে একটি চিরকুটে লিখলেন, পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা আপনার জন্যে যে সময়টুকু বরাদ্দ করেছেন, সেটা সঠিক কাজে ব্যয় করুন। আমি সারাজীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে একটা ঘণ্টাও কিনতে পারি নি। পৃথিবীতে আমাদের জন্মটা ক্ষণস্থায়ী একটি সফর মাত্র। এই ক্ষণস্থায়ী সময়টা কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। যে সম্পদ প্রয়োজনের মুহূর্তে কোনো কাজে আসে না তার পেছনে সময় ব্যয় করাটা অকাজ ছাড়া আর কী বা হতে পারে? তার মানে এই নয় অর্থ-সম্পদ উপার্জন করার প্রয়োজন নেই। অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তবে তা কখনো প্রয়োজনের অতিরিক্ত নয়। প্রভুকে, পরিজনকে ভুলে, দরিদ্র-নিঃস্বদের ভুলে গিয়ে যে সম্পদ আমি ভোগ করব বলে জমিয়েছি, আজ সব ফেলে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি ..আরো কিছু লিখতে চাইছিলেন, কিন্তু এক মিনিট যে শেষ! ভোগের জন্যে জমানো সম্পদের ভার তাকে আফসোসে ভারাক্রান্ত করেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে বাধ্য করল।
আসলে এই যে ভোগী মনোবৃত্তি, যে আমার ধন, আমার উপার্জন, আমার কষ্টের টাকা আমিই ভোগ করব-এর পেছনের কারণ হচ্ছে লোভ। ভোগ এবং লোভ-এ দুটো যেন গলায় গলায় ভাব করে আসর ফেলে ব্যক্তিকে স্বার্থপর হতে উসকে দেয়। তার অবস্থা হয়-এই জগতে হায় সেই বেশি চায়, যার আছে ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি। মানে একটা পেলে আরো একটা পাওয়ার লোভ কাজ করে। কারণ উদ্দেশ্য যে ভোগ। একবার হোটেল সোনারগাঁওয়ে থাই মেলা হচ্ছিল। সেখানে একটি বেশ সচ্ছল পরিবারের মা, মেয়ে ও এক বছরের ছোট্ট নাতি এসেছেন। নাতিটিকে একবার নানি রাখছেন, আরেকবার মা রাখছেন। এভাবে পালা করে গিয়ে মা ও মেয়ে মেলায় ইচ্ছেমতো যা খুশি কিনছেন। সর্বশেষ কেনাকাটা ছিল একটি নেকলেস। মা একটি কিনেছেন। তারপর মেয়ে যখন মেলা ঘুরে মায়ের কাছে এসেছেন, বলছেন যে, মা এটা তো খুব সুন্দর। এরকম হুবহু আর একপিসই আছে। কিনে নাও তো! পরে যদি না পাও। মা-ও টাকার ব্যাগ নিয়ে ছুটলেন সে স্টলে। আহা রে, একটু পরে কেন, এক সেকেন্ড পরেও দমটা থাকবে কিনা সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারেন? কেউ না। তারপরেও এত দাম দিয়ে একই ডিজাইনের দুটো নেকলেস তিনি শুধু নিজের জন্যেই কিনতে যাচ্ছেন পরে যদি না পান, আফসোস হবে বলে।
অমর কথাসাহিত্যিক লিউ টলস্তয়ের কতটুকু জমি দরকার গল্পটি আসলে একটি মাস্টারপিস। গল্পে আমরা দেখি যে, লোকটি সূর্যোদয়ের পর থেকে হাঁটতে থাকল আর থাকল। সূর্য অস্ত যাওয়ার একটু আগে তার হুঁশ হলো যে, এখন ফেরা দরকার। কারণ শর্ত ছিল যে, যেখান থেকে হাঁটা শুরু করবে সূর্য ডোবার আগেই সেখানে ফিরে আসতে হবে। তাহলেই সে সেটুকু জমির মালিক হবে। বেশি জমির লোভ তাকে পেয়ে বসায় সে আরেকটু আগাই করে করে অনেকখানি চলে গিয়েছিল। যখন দেখল সূর্য হেলে পড়ছে। ফিরতে তো হবেই। বেচারা হেঁটে কুলাতে পারল না। দৌড়াতে শুরু করল। তারপর হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল জমিতে, সেখানেই তার জীবনের শেষ। এরপরে তার কতটুকু জমি লাগল আমরা জানি, সাড়ে তিন হাত। ভোগের লোভ করলে পরিণতি কখনোই ভালো হয় না।
আল কোরআনে ৫১ নম্বর সূরা জারিয়াত-এর ১৫ থেকে ১৯ নম্বর আয়াতে আছে-সেদিন আল্লাহ-সচেতনরা থাকবে প্রবহমান ঝর্নাবেষ্টিত জান্নাতে। তারা তাদের প্রতিপালকের পুরস্কারে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠবে। কারণ পার্থিব জীবনে তারা ছিল সৎকর্মশীল। তারা রাতে সামান্য অংশই ঘুমিয়ে কাটাত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করত, তাদের ধনসম্পত্তি থেকে অভাবী ও বঞ্চিতের হক আদায়ে অকাতরে ব্যয় করত। অর্থাৎ আমরা যা দান করি, কোরআনের দৃষ্টিতে তা দয়া নয়; তা অসহায়দের অধিকার বা হক্কুল ইবাদ। ঋগবেদ-এ বলা হয়েছে-মহাপ্রভুর দৃষ্টিতে কেউই বড় নয়, কেউই ছোট নয়, সবাই সমান। প্রভুর আশীর্বাদ সবারই জন্যে। আর প্রভুর আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে অন্যতম একটি করণীয় বলা হয়েছে-সমাজকে ভালবাসো। ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও। দুর্গতকে সাহায্য করো। নবীজী (স) খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, সৃষ্টির সেবায় যা ব্যয় করবে, তা-ই হচ্ছে তোমার সম্পদ, তোমার পরিত্রাণের উপায়। আর যা জমিয়ে রেখে যাবে, তা তোমার নয়; তোমার উত্তরাধিকারীর ভোগে ব্যবহৃত হবে।
ভোগী মনোবৃত্তি কখনো কাউকে শান্তি দেয় না।সাদরে ইস্পাহানী একবার নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘I am a poor millionaire’.—মিলিয়নিয়ার হওয়ার পরও তিনি নিজেকে দরিদ্রই ভাবছেন।
ভোগীর পরিণতি কখনো ভালো হয় না। এরিস্টটল ওনাসিস। তার একটা বিশাল প্রমোদতরী ছিল, যেটার প্রত্যেকদিনের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ছিল কয়েক হাজার মার্কিন ডলার। এই প্রমোদতরী ছিল শুধু তার প্রমোদ করার জন্যেই। এই এরিস্টটল ওনাসিসের একমাত্র ছেলে আলেকজান্ডার ওনাসিস, মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্লেন ক্র্যাশে মারা যান। একমাত্র মেয়ে ক্রিস্টিনা ওনাসিস এরিস্টটলের মৃত্যুর পর তার অগাধ সম্পদের ৫৫ শতাংশের উত্তরাধিকারী হন। কিন্তু ৩৭ বছর বয়সে ক্রিস্টিনা তার তিন বছরের কন্যাসন্তানকে রেখে আত্মহত্যা করেন। এই মেয়েটি এখন বড় হয়ে লড়ছে নিজের বাবার সাথে সম্পত্তির দখলদারিত্ব পাওয়া নিয়ে। এত অর্থবিত্তের পরও শান্তি নেই কেন? কারণ তার জীবনে বা তার পরিবারের সদস্যদের জীবনে কোনো দান ছিল না। বরং ছিল ভোগী মনোবৃত্তি, যে আমার ধন, আমার উপার্জন, আমার টাকা আমিই ভোগ করব।
আরেকজন ধনকুবেরের নামও আমরা জানি। ১২ বছর বয়সে মলিন, নোংরা পোশাকের জন্যে দারোয়ান যাকে পাবলিক পার্কে প্রবেশ করতে দেয় নি। তিনি সেদিন সেই পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, যখন আমার টাকা হবে এই পার্কটি আমি কিনে ফেলব। ৩০ বছর পরে এন্ড্রু কার্নেগি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। তিনি সেই পার্কটি কিনেছিলেন। সেখানে একটি নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন। সে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল-‘আজ থেকে দিনে বা রাতে, সকালে বা বিকেলে, যে-কোনো বয়সের, যে-কোনো মানুষ, যে-কোনো পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে’। ছিলেন বস্তির ছেলে। তারপর হলেন আমেরিকায় তার সময়কার সবচেয়ে বড় ধনকুবের। এমন একজন ধনকুবের যিনি জীবিতকালে তো বটেই, মৃত্যুর আগে নিজের সকল সম্পদ জনহিতকর কাজে দান করে গেছেন। দাতা ধনকুবের হিসেবে তিনি ইতিহাসে নিজের নাম লিখে যেতে পেরেছেন। এই সম্মান দানের মতো একটি মহতী কাজের অংশীদার হওয়ার জন্যেই অর্জিত হয়েছে।
একটু আগে পবিত্র কোরআনের উদ্বৃতি দিয়ে আমরা বলছিলাম, দাতা যখন দান করেন, তখন তিনি সৃষ্টির অধিকারকেই সম্মান করেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন। কী কী ভাবে তিনি সম্মানিত করেন?
এক, দান তার উপার্জনকে শুদ্ধ করে। দুই, দান তার দারিদ্র্য মোচন করে। তিন, দান তার রিজিকে বরকত দেয়। চার, দান তার ও তার পরিবারের বালা-মুসিবত ও রোগ-ব্যাধি দূর করে। পাঁচ, দান ভয়-পেরেশানি ও দুঃখ-কষ্ট দূর করে। ছয়, দান পাপ মোচন ও দাতার অন্তরে তৃপ্তি প্রদান করে। আমাদের আলোচনার শিরোনামে একটি বাক্য আছে-দানে আনে মুক্তি। এই যে একজন সম্মানিত দাতা এতগুলো দিক থেকে পুরস্কৃত হলেন, মুক্তি পেলেন, একজীবনে আর কী লাগে?
ইসলাম, সনাতন ধর্মের মতো পবিত্র বাইবেল-এও বলা হয়েছে এসব কাজে শরিক হওয়ার কথা-অভাবীদের সাহায্য করো। ঈশ্বরের সন্তুষ্টিমূলক কাজে অগ্রগামী থাকো। আর মহামতি বুদ্ধ বলেছেন-দানের অনন্ত কল্যাণ সম্পর্কে আমি যা জানি যদি মানুষ তা জানত, তাহলে কাউকে না দিয়ে সে অন্ন গ্রহণ করত না। বুদ্ধ বাংলার মানুষের কাছে এই বাণী ছড়িয়েছেন বলেই হয়তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাণীটি অনুসৃত হয়েছে। তবে দান করতে পারাটা একটি হেদায়েত, আশীর্বাদ। প্রভুর ইচ্ছাতেই দাতা হওয়া সহজ হয়। কারণ অর্থ থাকলেই দান করা যায় না। আমরা যখনই হাত খুলে দান করতে চাই তখনই মনে তৈরি হয় খচখচানি-দান করলেতো কমে যাবে! দান করে যদি হাতের সব খরচ করে ফেলি তাহলে আমার চলবে কী করে? কী দরকার এত দান-সদকার? ইবাদত-আমল কি কম করি! গরীবের আর দান কী? আগে বড়লোক হই, তারপর দান করব! হাত খুলে দেয়ার কী দরকার, ভিখারির হাতে দু’-চার টাকা দিলেই তো হলো! এমন নানা অহেতুক প্রশ্ন-দ্বিধা-বিভ্রান্তি এসে দানের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর এর সবই আসলে শয়তানের ধোঁকা। এজন্যে দাতা হওয়ার জন্যে সবসময় প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। দাতা হিসেবে আজকের চেয়েও আগামীকালকে বেশি দান করার জন্যে প্রার্থনা করতে হবে। প্রভু আমাদের কবুল করুন।