শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এ নিয়ে একটি ঘটনা বলছিলেন-আমরা তখন পাবনায় থাকি। ক্লাস এইটে পড়ি। একদিন স্কুলের স্কাউটিং স্যার বললেন, ‘ইছামতি ব্রিজটার নিচে কচুরিপানা বিশ্রীভাবে জমে গেছে, নদীটা মরে যাচ্ছে। চলো আমরা সবাই মিলে ওগুলো পরিষ্কার করে দিই।’ আমরা হৈ হৈ করে রাজি হয়ে গেলাম। একদিন সকালবেলা আমরা ৪০-৫০ জন স্কাউট গিয়ে নামলাম নদীতে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে ঘেমে-নেয়ে কাজ করতে করতে যখন প্রায় দুপুর হলো, হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, নদীর সেই অংশটা স্বচ্ছ পানিতে টলটল করছে। নোংরা আর দুর্গন্ধ সরে গিয়ে নদী ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। দৃশ্যটা দেখে গভীর শান্তিতে বুকের ভেতরটা ভরে গেল। একটা ভালো কাজ করতে পারার আনন্দে খুব ভালো লাগল। হঠাৎ মনে হলো, শুধু নিজের জন্যে নয়, সবার জন্যে এই যে কষ্টটা করলাম, এর মধ্যে এক অদ্ভুত তৃপ্তি আছে। সেদিনই প্রথম বুঝলাম-পাওয়ার মধ্য দিয়ে নয়, মানুষের বড় আনন্দ দেয়ার মধ্য দিয়েই। ধরুন, টয়লেট এমনভাবে ব্যবহার করতে বলা হয় যেন পরেরজনের ব্যবহার উপযোগী থাকে। পরেরজন ঢুকে যদি তৃপ্তি পান, কোনো দুর্গন্ধ বা ময়লা লেগে না থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে আগেরজনের জন্যে সেবা, সাদাকা হিসেবে প্রভু কবুল করবেন। আসলে পরিচ্ছন্নতা যেমন নিজের জন্যে, তেমনি এর প্রভাব পড়ে অন্যদের ওপর, পরিবেশের ওপর, সমাজের ওপর, দেশের ওপর।
ঢাকার রমনা পার্কে হেঁটে যাওয়ার সময়ে আমরা যারা অফিসার্স ক্লাবের সামনের রাস্তাটি ব্যবহার করেছি, তারা নিশ্চয়ই কয়েকটি গাছের নিচে সাদা চুনকাম করা দেখেছি। আসলে এটি চুন নয়, সর্বভুক পাখি বলে যে কাককে আমরা চিনি, যাদের দল, ঢাকা শহরের সিংহভাগ আবর্জনা খেয়ে নিচ্ছে বলে আমাদের ধারণা, সেই কাকের বিষ্ঠা। অনেক সময় মিসড কলের মতো রাস্তার পিচে না পড়ে এই বিষ্ঠাটি নিচে দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীর মাথায় পড়ে। বেচারা পথচারী! গাছের ছায়া পেতে গিয়ে বিষ্ঠার গন্ধে ভুগতে থাকেন পরবর্তী কিছুক্ষণ। এটি না হয় মানা যায় যে একটি পাখি না বুঝে কাজটি করেছে। বরং পথচারীরই সাবধান হয়ে ঐ গাছটির নিচ দিয়ে না যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কোনো পথচারী হেঁটে যাওয়ার সময়ে বা দাঁড়িয়ে কারো সাথে আলাপ করার সময়ে যদি তাদের ওপর পানি ফেলেন কেউ, বা দাঁত ব্রাশ চলাকালীন পেস্টসমেত থুতু ফেলেন কেউ বা এমন কিছু ফেলেন, যা ফেলা উচিত নয়, তাহলে তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ কী থাকবে? ভাই/ আপা, দয়া করে ভালো হয়ে যান। ভালো হতে শুধু ইচ্ছাটাই লাগে। আমাদের মতো সোনার দেশের সোনার মানুষের জন্যে ধমক, চাবুক, তলোয়ার লাগবে না, শুধু যিনি অনুরোধ করছেন তার পক্ষ থেকে মমতা লাগবে আর যিনি অপরিচ্ছন্ন কাজটি করছেন তার দিক থেকে ইচ্ছা লাগবে, আন্তরিকতা লাগবে, সচেতনতা লাগবে।
একজন ভাই ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন। সামনে হাঁটতে থাকা দুজনের একজন পিচকিরি মারার মতো করে থুতু ফেললেন। সেটা সেই ভাইয়ের পায়ের ঠিক বরাবর পড়ল। লোকটি সরি সরি বলে উঠলেন। সেই ভাই বললেন যে, আমাকে সরি বলার কী দরকার। বাংলাদেশকে সরি বলেন। আপনারা যখন সিঙ্গাপুরের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকবেন, তখন তো এই বাংলাদেশকে নিয়ে হায় হায় করে উঠে বলবেন যে, দেখছ কত নোংরা, রাস্তায় কত কফ-থুতু! আর এই দেখ সিঙ্গাপুর। কত্ত ফকফকা রাস্তা। এই কৃতিত্ব কি সিঙ্গাপুর নামক দেশটির নাকি সে দেশের অধিবাসীদের? আর নোংরা হওয়ার দোষটা কি বাংলাদেশের না বাংলাদেশের মানুষের? প্রশ্নটার উত্তর নিয়ে দয়া করে একটু ভাবি। দেশের কি হাত পা মুখ আছে? বলবেন যে, নাই তো, এটা কি কোনো প্রাণি। আমি বলব আছে। দেশের একটা অস্তিত্ব আছে। আর এই দেশ হলো এমন একটা মা, যে মা তার সন্তানদের হাত-পা-মুখ ব্যবহার করেন। সন্তান যখন ভালো কথা বলে, সবাই বলে তার মা না জানি কত ভালো কথা জানেন। সন্তান যখন দুহাত দিয়ে ভালো কাজ করে, সবাই অবাক হয়ে ভাবে যে, না জানি তার মা কত পারদর্শী। সন্তান যখন দু পা দিয়ে সাফল্যের পথে হাঁটে, সৎপথে চলে সবাই বলে মা সৎ-দক্ষ বলে সন্তানও এমনটি হয়েছে।
অর্থাৎ সন্তানের সুনাম মানে মায়ের-বাবার সুনাম। এক বিয়ে বাড়ির গেটে গাড়ি থেকে একটি পরিবার নামছিলেন। সবাই এগিয়ে এসে পরিবারের বড় ছেলেটিকে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। কারণ সে সম্প্রতি লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ছেলের অভিনন্দন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মা-বাবাকেও তখন উজ্জ্বল করে তুলছিল। দেশটাও তো আমাদের মা। এই মায়ের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্যে দেশের মানবসন্তান হিসেবে মূল দায়িত্ব আমার, আপনার, আমাদের। এই দৃষ্টিভঙ্গি যদি ঠিক থাকে, তাহলেই আজকের আলোচনা ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতাই দেশকে পরিচ্ছন্ন করবে-বিষয়টি আমাদের হৃদয়ে গেঁথে যাবে।
আমাদের জীবনে পরিচ্ছন্নতার কী অবস্থা-একজন সচেতন নাগরিকের লেখনী থেকে তার কিছুটা হলেও বুঝতে পারব। তিনি লিখেছেন যে-আমরা থুতু ফেলি যত্রতত্র। হাঁচি দেই নাকে কোনো কিছু না দিয়ে। যেখানে-সেখানে নির্বিচারে ময়লা ফেলি। বাদামের খোসা, চিপসের প্যাকেট, কলার খোসাসহ উচ্ছিষ্ট অনেক কিছু অবলীলায় রাস্তায় কিংবা পাশের ড্রেনে ফেলি। খালের পাশে যেসব আবাসিক ভবন আছে, সেখানে অনেক বাসিন্দা ময়লা পরিষ্কারের খরচ বাঁচাতে ঘরের যাবতীয় আবর্জনা জানালা দিয়ে সোজা খালে ফেলে দেন বলেও কথিত আছে। অনেক হোটেলকে দেখেছি, ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্যে পার্শ্ববর্তী ম্যানহোল ব্যবহার করছে। এসব কারণে পরিবেশ দূষিত হয়। রোগ-জীবাণুর বিস্তার ঘটে। রাস্তা অপরিচ্ছন্ন হয়, দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়।
এদেশের হোটেলগুলোর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। বেশিরভাগ হোটেলে শেফ এবং খাবার পরিবেশনকারী কর্মীদের পোশাক এবং কর্মপ্রক্রিয়া স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শেফরা রান্না করেন মাস্ক এবং হেডকভার ব্যবহার না করেই। পরিবেশন কর্মীদেরও একই অবস্থা। মাস্ক নেই, হেডকভার নেই। খাদ্য পরিবেশনে ব্যবহার করা হয় খোলা হাত। টেবিল মোছা হয় ময়লা ‘ন্যাকড়া’ দিয়ে। একই প্লেট বার বার তোয়ালে দিয়ে মুছে খাবার পরিবেশন করা হয়। যে তোয়ালে দিয়ে প্লেট মোছা হয়, তা সর্বশেষ কবে যে ধোয়া হয়েছে; তা বলা কঠিন। আবার যে হাত দিয়ে এসব তোয়ালে ধরা হয়, সেই হাত দিয়ে খাবারও ধরা হয়। কোনো গ্রাহকের রেখে যাওয়া খাবার আবার অনায়াসে অন্য গ্রাহকের পাতে তুলে দেয়া হয়। তাছাড়া খাবার রাখা হয় ঢাকনা দেয়া ছাড়া। এতে খাবারে মাছি বসে। খাবারে চুল, তেলাপোকা ও টিকটিকি পাওয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটে থাকে। এসব কারণে যারা হোটেলের খাবারের ওপর নির্ভরশীল এবং যারা শখের বশে হোটেলে খান, তারা চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন।
এদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা তথৈবচ। যেখানে-সেখানে বর্জ্য পড়ে থাকার যে চিত্র সরকারি হাসপাতালগুলোয় দেখা যায়, তা অনভিপ্রেত। সরকারি হাসপাতালগুলোর শৌচাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা জানেন এগুলো কী পরিমাণ অপরিচ্ছন্ন ও পূতিগন্ধময়। একবার এক মা সারাদিন পানি খান নি টয়লেটে যাওয়ার ভয়ে। ছেলে আইসিইউতে ছিল, তার সামনেই করিডোরের মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে বসেছিলেন। করিডরগুলোয় থুতু ও কফ পড়ে থাকার দৃশ্য একেবারে স্বাভাবিক। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও আশানুরূপ নয়। যেখানে স্বাস্থ্যবিধি পালনের অনন্য নজির স্থাপন করার কথা ছিল এ হাসপাতালগুলোর, সেখানে এরকম করুণ চিত্র নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বলা হয়ে থাকে, যেখানে অসুস্থ মানুষ হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে ফেরার কথা; সেখানে আমাদের হাসপাতালগুলোয় সুস্থ মানুষ গিয়ে অসুস্থ হওয়ার উপক্রম হয়।
অথচ পবিত্র গ্রন্থসমূহে পরিচ্ছন্নতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে : সূরা আল মুদাসসির-এর ৪-৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(হে মুহাম্মদ) তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ (পরিমণ্ডল) পরিচ্ছন্ন-পবিত্র রাখো। আর অপরিচ্ছন্নতা-অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকো।’ নবীজী (স)-র উম্মত হিসেবে আমাদের জন্যেও এই নির্দেশ প্রযোজ্য। ইসলামে পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষ অজু ও গোসলকে ফরজ (অত্যাবশ্যক) করা হয়েছে। মদিনার নিকটবর্তী কুবার লোকজন খুবই পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতেন। পরিচ্ছন্ন মানুষদের ভূয়সী প্রশংসা করে কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘…… আর আল্লাহ পরিশুদ্ধি-প্রয়াসী মানুষকে ভালবাসেন।’ সূরা তওবা ১০৮নং আয়াত। সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থে পরিচ্ছন্নতাকে একটি অন্যতম গুণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা-পবিত্রতা (দেহ-মনের পরিচ্ছন্নতা) ঈমানের অর্ধেক।—আবু মালেক আশয়ারী (রা); মুসলিম। কোন কোন ক্ষেত্রে কীরূপে পরিচ্ছন্ন হতে হবে তা পবিত্র হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। নবীজী (স) বলেছেন-ঘুম থেকে উঠে কোনো তৈজসপত্র ধরার আগে তিন বার হাত ধোবে। কারণ তুমি জানো না তোমার হাত ঘুমের মধ্যে কী কী স্পর্শ করেছিল। নবীজী (স) ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই মেসওয়াক (দাঁত ব্রাশ) করতেন। কারণ মেসওয়াক (অর্গানিক টুথব্রাশ) মুখ পরিষ্কার রাখে। আল্লাহ এতে খুশি হন। একবার নবীজী (স) বলছিলেন, আমার উম্মতের জন্যে কষ্টকর হবে মনে না করলে আমি প্রত্যেক নামাজের আগে মেসওয়াক (দাঁত ব্রাশ) করার নির্দেশ দিতাম।
পরিচ্ছন্নতার শারীরিক-মানসিক প্রভাব : ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস এঞ্জেলেসের একদল গবেষক ২০০৯ সালে এক গবেষণা পরিচালনা করে যে ফলাফল পান তাতে দেখা যায়, যেসব মানুষের বাসস্থান অগোছালো তারা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে ভোগেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখান-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মনোযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। সেইন্ট লরেন্স ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, শোবার ঘরের নোংরা পরিবেশ গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। পবিত্র হাদীস শরীফ থেকেও আমরা জেনেছি যে, তোমরা বিছানায় ঘুমাতে এলে আগে কোনো কাপড় দিয়ে বিছানা ঝেড়ে নেবে। কারণ বিছানায় এমন ক্ষতিকারক কিছু থাকতে পারে, যা তুমি জানো না-আবু হুরায়রা (রা); তিরমিজী
আমাদের শরীরে বেশিরভাগ রোগ-ব্যাধি দানা বাঁধে একমাত্র অপরিচ্ছন্নতার কারণে। অনেকে আছে নিয়মিত গোসল করে না, ঠিকমতো দাঁত ব্রাশ করে না। এর ফলে কী হয়? শরীরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রকার ছোট ছোট রোগ দেখা দেয়। আর এই ছোট ছোট রোগই একদিন বড় আকার ধারণ করে। তাই কোরআনে মানুষকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, যারা তওবা করে ও পবিত্র থাকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালবাসেন।
আপনাদের হয়তো মনে পড়বে যে, ২০২০ সালে যখন করোনার প্রকোপ তুঙ্গে রাস্তায় তেমন কোনো থুতু চোখে পড়ত না। তখন তো প্রকাশ্যে কাশি দিতে বা কফ বের করতে মানুষ ভয় পেত, গিলে ফেলত। না জানি তাকে করোনা রোগী মনে করে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেয়। হাঁচি বাধ্য হয়েও যখন দিত, তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে একদম ছোট্ট করে। যাতে বেশি শব্দ না হয়। অন্যরা সন্দেহ করবে। লকডাউন চলাকালে এক টিভি সাক্ষাতকারে মাস্ক পরা এক ছাত্র বলছিল যে, তার সবচেয়ে বড় চাওয়া, সে নিজে যেন অন্য কারো ক্ষতির কারণ না হয়। তার চিন্তার এই ধারাটি খুব পরিচ্ছন্ন। আমরা নিজেদের মৃত্যুর ভীতিতে মাস্ক পরে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে ঘুরছিলাম। আমার যেন কিছু না হয় এই শুধু আমাদের চিন্তা। আমাদের থেকে অন্য কারো যেন কিছু ক্ষতি না হয়, তা আমরা কয়জন ভেবেছি? একবার যদি সবাই ভাবত, তাহলে রাস্তায় আর কেউ থুতু ফেলত না। তেমনিভাবে রাস্তাঘাটে, ঘরের জানালা দিয়ে যত্রতত্র ময়লা-বর্জ্য ফেলত না। এই যে অন্যদের বিষয়ে দায়িত্ববোধ-এটাও আত্মিক পরিচ্ছন্নতার একটি অংশ। আসলে স্বার্থপর হয়ে আমরা কতদিন ভালো থাকব? একা কি ভালো থাকা সম্ভব? কখনোই না। সবাইকে নিয়ে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
আর সেজন্যে কোনো ভাইরাসের ভয়ে বা জরিমানার ভয়ে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন থাকব-এটা কোনো কথা হলো না। যেমন সিঙ্গাপুরের শপিং সেন্টারগুলোতে বিক্রি হওয়া টি-শার্টে একটি কথা প্রায়ই মুদ্রিত থাকে ‘সিঙ্গাপুর : জরিমানার নগরী’। দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটিতে রয়েছে বিচিত্র নানা আইন। একটু বেখেয়াল হলেই দিতে হয় জরিমানা। বিদেশিদেরও এগুলো মেনে চলতে হয়। চুইংগাম তো নিষিদ্ধই। ট্রেনে ডুরিয়ান (কটুগন্ধের ফল) বহন কিংবা টয়লেট ফ্লাশ না করলে গুণতে হয় জরিমানা। রাস্তায় থুতু কিংবা অনুমতি ছাড়া ওয়াইফাই ব্যবহার করলেও ছাড় নেই। ই-সিগারেটের ওপরও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। দৃষ্টিকটু যে-কোনো কিছু জরিমানাসহ নিষিদ্ধ করা সিঙ্গাপুরের একটি রীতি। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার দায়ে গড়ে বছরে ১০ হাজার জন জরিমানার কবলে পড়েন। এজন্যে একজনকে গুণতে হয় কমপক্ষে ২১৭ ডলার।
আমরা আইন করে পরিচ্ছন্ন থাকতে বাধ্য হতে চাই না। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ-শিশু থেকে শুরু করে প্রবীণ, সবাই যেন নিজেদের প্রেরণা থেকে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করেন। এই পরিচ্ছন্নতা যেমন দেহের, তেমনি তার চারপাশের পরিবেশের। তার শরীরে-পোশাকেও থাকবে স্নিগ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা। তিনি যেখানে থাকবেন, সে পরিবেশটিতেও থাকবে ছিমছাম, পরিচ্ছন্নতা। এবং অবশ্যই তাকে মনের দিক থেকে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। অনেক সময় আমরা বলি সাদা মনের মানুষ, আসলে রঙিন মনের মানুষও হতে পারেন তিনি। কিন্তু মূল বৈশিষ্ট্য হতে হবে তার মনে কোনো বিদ্বেষ থাকবে না, রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণার মতো আবর্জনা থাকবে না। রাগ ক্ষোভ ঘৃণা বিদ্বেষ হিংসা ভয় হীনম্মন্যতা ও সকল প্রকার নেতিবাচকতা হলো মনের আবর্জনা। নিয়মিত মেডিটেশনে এই আবর্জনা দূর হয়। নিশ্চিত হয় আমাদের মানসিক পরিচ্ছন্নতা।
এবার তাহলে আসি যে, সার্বিকভাবে পরিচ্ছন্নতার জন্যে কী করতে হবে? শুদ্ধাচারের কিছু বিষয় মনে রেখে অনুসরণ করলেই হবে। এগুলো পরিচ্ছন্নতার শুদ্ধাচার।আসলে শুদ্ধাচার মানার আগে শুদ্ধাচার জানতে হয়। যেমন ধরুন, একজন বলছিলেন যে, তিনি সকালে নাশতার পরে দাঁত ব্রাশ করতেন। শুদ্ধাচার বইটি থেকে জানলেন যে, সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাঁত ব্রাশ করার পরামর্শ এসেছে। আসলে এইভাবে এক এক করে জানাটা তখনই সার্থক হবে যখন জানার পরে তা মানার চেষ্টা করা হয়। ভালো দেশের জন্যে ভালো মানুষ লাগে। আর ভালো মানুষ মানেই শুদ্ধাচারী মানুষ। যিনি শুদ্ধাচার জানেন এবং মানার চেষ্টা করেন।
আসলে পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি ও স্বাস্থ্যকর দেশে পরিণত হওয়ার মূলে রয়েছে জনসচেতনতা। সিঙ্গাপুর নামক দেশটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউয়ের শুরু করা ‘কিপ সিঙ্গাপুর ক্লিন’ প্রচারাভিযানের ৫০ বছর পার হয়েছে ইতোমধ্যে। দেশটির রাজধানী সিঙ্গাপুর সিটির যে-কোনো রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে গেলে অবশ্যই ময়লার ট্রাক চোখে পড়বে, যেটি ওইদিনের বর্জ্য সংগ্রহের জন্যে অপেক্ষমাণ। তাই বুঝতে সময় লাগার কথা নয়, কেন শহরটি এত পরিষ্কার। ‘আপনার হাত ব্যবহার করুন’ এর আওতায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরাও স্কুল পরিষ্কারে অংশ নেন। পরের বছর নেয়া হয় নদী পরিষ্কারের উদ্যোগ। বর্তমানে সিঙ্গাপুরের নদীর পানি এতই স্বচ্ছ যে, তা পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ১৯৬৮ সালে সিঙ্গাপুর সিটিতে এক অনুষ্ঠানে লি কুয়ান ইউ বলেন, ‘প্রশান্তির শহর গড়াই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে একটি পরিচ্ছন্ন নগরই গড়বে শক্তিশালী অর্থনীতি।’ সিঙ্গাপুর সেসব লক্ষ্য সফলভাবেই পূরণ করেছে। দেশটির প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৬৬ থেকে বেড়ে এখন ৮৪ বছর। ১৯৬৭ সালে পর্যটকের সংখ্যা ছিল দুই লাখ। ২০১৯-কোভিড শুরুর আগে সে সংখ্যা এক কোটি ৯১ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) যেখানে মাত্র ৯ কোটি মার্কিন ডলার ছিল, ২০২১ সালেই তা ১৬২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এফডিআই গ্রহণের দিক থেকে সিঙ্গাপুর এখন বিশ্বে সপ্তম। আসলে ভালো থাকার জন্যে প্রথম প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতা। আর পরিচ্ছন্নতার জন্যে প্রয়োজন সচেতনতা। দেহ ও মনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিজেকে যেমন ভেতর থেকে সতেজ রাখে তেমনি অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। আর পারিপার্শ্বিক পরিচ্ছন্নতা আমাদের দেশটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিতে পারে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটি ছোট্ট মেয়ে তার মা-কে জিজ্ঞেস করছে-এই বিস্কিটের প্যাকেটটি এখানে কে ফেলেছে? মা বলেছেন, যে ফেলেছে সে এ দেশকে ভালবাসে না। আমরা কি বাংলাদেশকে ভালবাসি? প্লিজ মনে মনে নয়, জোরে বলুন, দরদ দিয়ে বলুন, ভালো কি বাসি? ….. যদি বাসি, তাহলে বাংলাদেশকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এজন্যে পরিচ্ছন্ন মানুষ, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। চিন্তায়-কথায় পরিচ্ছন্ন হতে হবে। স্বাস্থ্যসুরক্ষায় পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। যার যার আবাসস্থল, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাক্ষেত্র গুছিয়ে ছিমছাপ রাখতে হবে। নিজের অংশটুকু গুছিয়ে, অন্যের অংশটুকু গোছাতেও সাহায্য করতে পারি। এটি তখনই পারব, যখন মনের পরিচ্ছন্নতা আমাদের থাকবে।
খুবই সুন্দর ও দরকারি একটি পোস্ট
স্যার আপনার লেখা গুলো সত্যি খুবই সুন্দর ও দরকারি,