ফিট থাকতে দেহের যত্ন নিন

ফিট থাকতে দেহের যত্ন নিন

সবসময় যেন সুস্থ শরীরে প্রশান্ত মনে কর্মব্যস্ত থাকতে পারি- সেই নিয়তেই আজকের আলোচনা। আজকে আমাদের নতুন করে কিছু বলার নেই। কেমন করে নিজেকে ফিট রাখতে হয়, কেন নিজের ফিটনেস জরুরি-কমবেশি সবাই আমরা জানি। তবে সবসময় জানাটা মানায় পরিণত হয় না। মানতে যেন পারি, সেজন্যেই আজকে আমরা একসাথে আবার একটু শুনতে চাই, মন ও মস্তিষ্কের সামনে বিষয়গুলো আনতে চাই। সেজন্যেই আমাদের আলোচনার বিষয়- ফিট থাকতে দেহের যত্ন নিন। এখানে আমাদের মধ্যে কেউই নেই যিনি যত্ন নিতে চান না। সবাই চান। সবসময় হয়তো পারেন না। কিন্তু চান যে এটা তো সত্যি।

এই যে চাওয়া- এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলি যে, না কাঁদলে মা-ও দুধ দেন না। তবে চাওয়ার মতো চাইতে হবে। কীভাবে চাইতে হবে সেটা নিয়ে গুরু-শিষ্যের একটি গল্প আছে। এক শিষ্য তার গুরুর খুব সেবা-শুশ্রূষা করায় গুরু সন্তুষ্ট হয়ে তাকে আশীর্বাদ করলেন। জানতে চাইলেন তার এমন একটি ইচ্ছার কথা যা তিনি পূরণ করে দেবেন। তবে শর্ত হলো, চাইতে হবে কেবল একটাই, তার বেশি নয়। শিষ্য তখন ভক্তিভরে জানাল যে, তার চাওয়া একটাই। আর তা হলো-‘আমি সাতমহলা বাড়িতে সোনার পালঙ্কে শুয়ে সুস্থ শরীরে নাতিপুতি পরিবেষ্টিত অবস্থায় তৃপ্তির সাথে মারা যেতে চাই।’ গুরু তখন বললেন, ‘চাওয়ার তুমি আর বাকি রাখলে কী?’ তার এ চাওয়ার মধ্যে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, পারিবারিক এবং আত্মিক- সবই ছিল। আমাদের এখন যে চাওয়া তা হচ্ছে টোটাল ফিটনেস। এই ফিটনেসের মধ্যে আমরা শারীরিক ফিটনেস চাই, মানসিক ফিটনেস চাই, সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেস চাই। এই চারটি ফিটনেস মিলিয়েই আমাদের টোটাল ফিটনেস। আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, টোটাল ফিটনেস শুরু হয়েছে শারীরিক ফিটনেস থেকে। অর্থাৎ এটা হচ্ছে বেইজমেন্ট। একটা ভবনের বেইজ যত শক্তিশালী হবে, তত ওপরের তলাগুলোর ভার নিতে পারবে। অথবা বলতে পারেন, শক্তিশালী বেইজের ওপর নির্ভর করে ওপরের তলাগুলো কত সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। ঠিক তেমনি ফিজিকেল ফিটনেস আয়ত্ত্ব হলে বাকিগুলো একটার পাশে আরেকটা এসে জড়ো হতে থাকবে। 

পাঁচ শতাধিক মাংসপেশি, দুই শতাধিক হাড়, ৭০ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন দেহকোষ বা সেলের সমন্বয়ে গঠিত এই শরীরের প্রতিটি সেলে খাবার পৌঁছানোর জন্যে রয়েছে শিরা ও ধমনীর ৬০ হাজার মাইল দীর্ঘ পাইপ লাইন। আর আমাদের হার্ট কোনোরকম ক্লান্তি বা প্রতিবাদ ছাড়াই প্রতিদিন এক লক্ষবার স্পন্দনের মাধ্যমে ১৬ শত গ্যালনেরও বেশি রক্ত পাম্প করে দেহকে সচল রাখছে। আমরা যদি নিজেকে অভাবগ্রস্ত মনে করি, তাহলে এর চেয়ে বড় ভ্রান্তি কিছুই হতে পারে না। কারণ আমাদের মনোদৈহিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্রেন হচ্ছে যে-কোনো কম্পিউটারের চেয়ে কমপক্ষে ১০ লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী।

এত মূল্যবান যে দেহ, যা আমরা বিনামূল্যে পেয়েছি, এর যত্ন নিতে হবে। ধরুন, কৃত্রিমভাবে পেটে ব্যাগ যার লাগিয়ে রাখা আছে মল জমা হওয়ার জন্যে, একজন ক্যান্সারে ভোগা রোগীর বোন বলছিলেন যে, সেটার দাম ১১০০ টাকা। প্রতিবার মল জমা হওয়ার পরে সেটি ফেলে দিতে হয়। এখন দিনে যদি দুবার মল জমা হয়, তাহলে কত টাকার ব্যাগ লাগে? দিনে ২২০০ টাকা। এখন আমরা যদি দিনে দুবার টয়লেটে গিয়ে মলত্যাগ করি, তাহলে প্রভু আমাদেরকে কত টাকা ব্যয় হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন? ২২০০ টাকার। খুব ভালো হতো যদি এই ২২০০ টাকা স্বাভাবিক নিয়মে মলত্যাগ করার জন্যে প্রভুর কাছে শুকরিয়াস্বরূপ আমরা সবাই প্রতিদিন সাদাকা করে দিতে পারতাম। আমরা নিজেদের জন্যে দোয়া করি যেন, প্রতিদিন এর চেয়েও বেশি পরিমাণ দান করার সুযোগ প্রভু আমাদেরকে দান করেন। আসলে অসুস্থ হলে শুধু যে দৈহিক কষ্ট হয় তা নয়, এই যে মনটা অস্থির হয়ে থাকে, তারপর কোন ডাক্তারের কাছে যাব- এ নিয়ে এখানে সেখানে অসহায়ের মতো খোঁজখবর নেয়ার যে পরিশ্রম সেটাও কম নয়। তারপর নামি ডাক্তার কে জানার পর তার কাছে সিরিয়াল নেয়ার জন্যে চলে আরেক প্রতিযোগিতা। সিরিয়াল পাওয়ার পরে এখন চেম্বারে গিয়ে অপেক্ষা। এই অপেক্ষা যেন শেষ হতে চায় না। একজন বলছিলেন যে, অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার জন্যে যে পরিমাণ পরিশ্রম, অর্থ, সময় ব্যয় হয় বা কখনো কখনো ভুল চিকিৎসার জন্যে ক্ষতি হয়, এর থেকে ভালো সুস্থ থাকার জন্যে সময় ব্যয় করা। অথচ চাইলে কোনো খরচ ছাড়াই সুস্থ থাকা যায়। এজন্যে দরকার যত্নায়ন।   

একজন পিঠাবিক্রেতাকে দেখবেন যে চুলাটা দিয়ে, যে যে সরঞ্জাম দিয়ে তিনি পিঠা বানান, পিঠা বানানোর আগে সেগুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেন, বানানোর পরেও পরিষ্কার করেন। এটাই যত্নায়ন। ঠিক একইভাবে দেহের শুদ্ধি প্রয়োজন, প্রয়োজন কিছু মৌলিক যত্নায়ন। এই যত্নায়নের জন্যেই প্রয়োজন প্রতিদিনের করণীয়গুলোকে একটি রুটিনে নিয়ে আসা। যাতে যত্নের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় থাকে।

সাইকোলজিস্টরা গবেষণা করে দেখেছেন একজন মানুষের ডিসিপ্লিন এবং মেধার অনুপাত। যার মেধার অনুপাত ৯৩ শতাংশ, ডিসিপ্লিনের অনুপাত সাত শতাংশ; তার জীবনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর একজন মানুষ যদি ৯৩ শতাংশ ডিসিপ্লিনড হয় এবং সাত শতাংশ মেধা তার থাকে, তার জীবনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ শৃঙ্খলা মানেই হচ্ছে নিয়ম। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে একটা প্রক্রিয়া। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে একটা চর্চা। শৃঙ্খলা মানে হচ্ছে একটা অনুশীলন। এবং যিনি নিয়মিত অনুশীলন করেন তার যে সাফল্য এটা অন্য কারো জীবনে আসতে পারে না। সুস্থতাও কিন্তু শারীরিক সাফল্যের একটি দিক। শারীরিক ফিটনেসের জন্যে এখন এই দেহের যত্ন আমরা নিতে চাই শৃঙ্খলার সাথে।

এই শৃঙ্খলার প্রথম কথা হচ্ছে- একটা ভালো ঘুম। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছয় ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। যারা মেডিটেশন করেন দুবেলা ৩০ মিনিট করে তাদের জন্যে বড়জোর সাড়ে চার ঘণ্টা বিছানায় ঘুম যথেষ্ট। কারণ ৩০ মিনিট মেডিটেশন দু ঘণ্টা ঘুমের সমান উপকার করে। তাহলে সারাদিনে এক ঘণ্টার মেডিটেশন চার ঘণ্টা ঘুমের সমান। বাকি যে সাড়ে চার ঘণ্টা ঘুম, এটা যেন সুন্দর হয় সেজন্যে আমাদের শুরু করতে হবে ডিজিটাল ফাস্টিং। রাত ১১ টার মধ্যেই পারিবারিকভাবে সব ধরনের ডিভাইস বন্ধ করে, দাঁত ব্রাশ করে, হাত-মুখ ধুয়ে সোজা যেতে হবে বিছানায়। শুধু মাথার নিচের বালিশ বা কোলবালিশ নিয়ে নয়; মমতা, ক্ষমা ও প্রত্যাশাকে সঙ্গী করে ঘুমাতে হবে। শোকর আলহামদুলিল্লাহ, প্রভুকে ধন্যবাদ বলতে বলতে ঘুমাতে হবে। ফলে পরদিন সুবহে সাদিকে বা ভোরে যখন ঘুম ভাঙবে, তখন দেখবেন দারুণ এক সাফল্য সঙ্গীতের সুর কানে বেজে উঠবে। খুব ভালো লাগবে দিনটা। মুখ দিয়ে আপনাতেই বের হয়ে যাবে শোকর আলহামদুলিল্লাহ, প্রভুকে ধন্যবাদ, একটি সুন্দর নতুন দিনের জন্যে।

আসলে যখন আপনি রাতে গভীর ঘুমিয়ে ভোরবেলা উঠছেন কাকডাকা ভোরে আজানের সাথে সাথে তখন ভোরের এই যে বাতাস, সুবহে সাদিকের যে নির্মল বাতাস এটা অক্সিজেন এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকে। কল-কারখানা চলার ফলে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় নির্মল বাতাসটা তাতে নষ্ট হয়ে যায়। রাতেরবেলা সাধারণভাবেই মানুষজন ঘরে থাকে, ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকে, রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল কম থাকে। যার ফলে ভোরের খুব নির্মল বাতাস দেহমনকে চাঙ্গা করে ফেলে, চনমনে একটা ভাব চলে আসে। যারা সকালবেলা উঠে দিন শুরু করেন দিনের বরকত তারা পান এবং তারা অন্যদের চেয়ে ধীরস্থির সুশৃঙ্খল এবং নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ পান। কেন? ভোরবেলা যখন ওঠা হয়, দিনটা অনেক লম্বা হয়ে যায়। আর ভোরবেলা যদি না ওঠেন তাহলে দিনটা ছোট হয়ে যায়। এবং যারা সকালবেলা হাঁটতে বের হন বা ইয়োগা করেন, ব্যায়াম করেন, তারা তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন। অন্যদের চেয়ে তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

ইয়াহুর প্রধান নির্বাহী রাতে চার ঘণ্টা ঘুমান এবং ভোর সাড়ে চারটায় তিনি ওঠেন। ই-মেইল চেক করেন। তারপরে জিমে চলে যান। আর ইয়াহু আমরা যারা ব্যবহার করি, ভোর সাড়ে চারটায় ঘুমোতে যাই। টুইটারের যিনি সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি, তিনি ভোর সাড়ে পাঁচটায় ওঠেন। এরপর প্রথম মেডিটেশন করেন। তারপর ছয় মাইল জগিং করেন। এরপরে দিনের কাজ শুরু করেন। অর্থাৎ প্রযুক্তি দানব যারা, প্রযুক্তি ব্যবহার করে যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন, তারা কিন্তু এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের ঘুম হারাম করেন নাই। তারা নিজেরা ভালোমতো ঘুমিয়েছেন এবং বুদ্ধি পাকিয়েছেন যে অন্যের ঘুম কীভাবে হারাম করা যায়।

আসলে আপনি দুটো পথ বেছে নিতে পারেন। রাতের প্যাঁচা হতে পারেন। প্যাঁচা কী করে জানেন তো? রাতে জেগে থাকে। আবার আদর্শলিপির কবিতা আছে না-‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’। রাতের প্যাঁচাও হতে পারেন, সকালবেলার পাখিও হতে পারেন। এখন কী হবেন এটা আপনার ওপরে নির্ভর করছে। একদিন দুইদিন জরুরি প্রয়োজনে রাত্রি জাগলেন এটা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু রাত জাগাটাই যখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই, বিশেষত মেলাটোনিন যে হরমোন, এই হরমোনের প্রবাহের যে ছন্দ এই ছন্দটা নষ্ট হয়ে যায় এবং এ ছন্দ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে কী হয়? জ্বর জ্বর ভাব থাকে। ঠান্ডা লাগা, এসিডিটি এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়। অনিদ্রা তো আছেই। অনিদ্রার পরিণতি হচ্ছে অল্প বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া। বুদ্ধিবৃত্তিক যে কর্মধারা-সৃজনশীলতা বলেন, প্রাণবন্ততা বলেন, কর্মতৎপরতা বলেন, কমে যায় যদি রাতের ঘুমটা ঠিকভাবে একজন ঘুমোতে না পারেন। যখন ঘুমের সাইকেলটা নষ্ট হয়ে যায় তখন দেহঘড়ির সমস্ত সাইকেলই নষ্ট হয়ে যায়। এই যে মন আমার দেহঘড়ি সুন্দর করি কোন মিস্ত্রী বানাইয়াছে! এই যে দেহঘড়ি বা জৈবঘড়ির সময়ের যে সাইকেল বা চক্র, সময়ানুসারে কাজের যে প্রক্রিয়া এটা নষ্ট হয়ে যায়।

এখন থেকে হাজার বছর আগে। খুব নির্মম সত্য কথা খনা বলে গিয়েছিলেন ‘সকাল শোয় সকাল ওঠে, তার কড়ি বৈদ্য না লুটে’! কড়ি মানে টাকা। বৈদ্য মানে হচ্ছে, এখনকার ভাষায় চিকিৎসক! কারণ রোগ হলে মানুষ চিকিৎসকের কাছে যায় এবং টাকাটাও চিকিৎসকের কাছে যায়। আসলে এই বাংলার মানুষের ব্রেন অত্যন্ত শার্প। কেন? কারণ বাংলার মানুষের মনে মায়া আছে এবং অন্তরে স্রষ্টাপ্রেম আছে। মানুষের প্রতি প্রেম, স্রষ্টার প্রতি প্রেম এবং যে-কারণে আমাদের পূর্ব পুরুষরা অনেক জ্ঞানী ছিলেন, অনেক প্রাজ্ঞ ছিলেন, অনেক মানবিক ছিলেন। আমরা পূর্ব পুরুষদের যে সত্যজ্ঞান, এই জ্ঞান থেকে দূরে সরে যাওয়াতে কী হয়েছে? এক রিপোর্ট বলছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে। এখন তো আসলে চিকিৎসক যে, খুব একটা পায় তা না। ক্লিনিকওয়ালারা যারা মানে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি কোনো কথা নাই বার্তা নাই এমআরআই! এমআরআই কতটুকু প্রয়োজন এটা তো তারাই বলতে পারেন। এমআরআই করো এই করো সেই করো। ওষুধ খাওয়ার আগে ৫০-৬০ হাজার টাকা এমনি চলে যায়। ওষুধ খেতে হবে, খাওয়ার প্রস্তুতি নিতে ৫০-৬০ হাজার টাকা শেষ! কেন? সবসময় মনে রাখবেন- প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ ঘুম। রাতে যদি আপনি ঘুমান এবং সকালবেলা যদি ওঠেন চিকিৎসার পেছনে আপনার ব্যয় হবে সবচেয়ে কম।

শৃঙ্খলার দুই নম্বর বিষয় হচ্ছে, সকালের নাশতা। অবশ্যই দান করে নাশতা গ্রহণ করা উচিত। নিজে খেতে পারার শুকরিয়া জানিয়ে এবং নিরন্নের খাবারের নিশ্চয়তার জন্যে আমরা দান করছি। খাবার সাধারণত তিনবেলা হলেও দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার হচ্ছে সকালের নাশতা। আসলে নাশতা শুনলে মনে হয় স্ন্যাকসের কথা। আমরা বেলা ১১টা বা বিকেল ৪/৫টায় স্ন্যাকস ভাবতে পারি। অবশ্য যারা ওজন কমাতে চান, তারা এই পর্বটা অবশ্যই বাদ দেবেন। আমরা সকালের খাবারকে বলি ব্রেকফাস্ট। মানে ফাস্টিংকে ব্রেক করা। আগের দিন সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে খেয়ে ফেললে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত যে ১২ ঘণ্টা ফাস্টিং চলে দেহে, সেটিকে ব্রেক করার জন্যে আমাদের পূর্বপুরুষরা কিন্তু নাশতা করতেন না। তারা ভাত খেতেন, লাল চালের ভাত। এইজন্যেই তারা এত শক্তিমান ছিলেন, বুদ্ধিমান ছিলেন। আসলে এই সকালের খাবার- রুটি বা ভাত যেটা পাওয়া যায়, এটা হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী। আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি, তারা ২০১৯ সালে একটা গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, সকালের নাশতা জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। আর সকালের নাশতা যদি বাদ দেয়া হয় তাহলে কী হয়? আমাদের অনেকে এখন কী করে? এখন কিন্তু ব্রেকফাস্ট করে না। এখন ব্রাঞ্চ করে দুপুর ১২টার সময়। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চ একত্রে এটার নাম হচ্ছে ব্রাঞ্চ। এবং এই ব্রাঞ্চ যারা করে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি ১৯ শতাংশ বেশি। এবং সকালবেলা যারা ওঠে পরীক্ষার স্কোর তাদের ভালো। যারা দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে তাদের পরীক্ষার স্কোর তুলনামূলকভাবে খারাপ হয়।

ইংল্যান্ডের আর্সেনাল ক্লাবের খেলোয়াড়দের সকালবেলার খাবার হচ্ছে চাল সিদ্ধ। চাল সিদ্ধ মানে কী? ভাত। সবজি, ডাল। কারণ আর্সেনাল ক্লাবের যে কোচ, আর্সেন ওয়েঙ্গার, যিনি ২২ বছর কোচ ছিলেন, যিনি ক্লাবকে দাঁড় করিয়েছেন, তিনি অনেক গবেষণা করে দেখলেন যে বাঙালি খাবার না খেলে খেলোয়াড়দের এনার্জি বাড়ে না। তাদের স্ট্যামিনা বাড়ে না।

একবার এক নবজাতকের মা-কে একজন চিকিৎসক বলছিলেন যে, যদি আপনার শিশুর খাওয়া, ঘুম ও প্রস্রাব-পায়খানা প্রতিদিন ঠিক নিয়মে হয়, তাহলে বুঝবেন যে শিশুটি ভালো আছে। কিন্তু এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, শিশু শুধু নয়, বড়দেরও যদি ঘুম, খাওয়া ও টয়লেট ঠিক থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তিনি ভালো আছেন। একবার একজন প্রবীণ ব্যক্তি খুব তৃপ্তির সাথে বললেন যে, বিশ্বজয় করলাম। সেটা এক সকালবেলা ছিল। যাকে বলছিলেন তিনি বললেন যে, কোথায় আপনি তো বাসাতেই ছিলেন। তিনি বললেন, এই দুই মিনিট আগে টয়লেটে ঢুকেছিলাম। এক মিনিটে ত্যাগ করে শান্তি নিয়ে বের হয়ে এলাম। এটাই আমার কাছে বিশ্বজয়। আসলে যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য বা কোষ্ঠবদ্ধতা আছে, তারা জানেন যে, টয়লেটে ত্যাগ করে আসতে পারলে কত সুখী লাগে। এই বিশ্বজয়ের আনন্দ অনুভূতি যেন প্রতিদিন আসে, সেজন্যে কোন আসন? বঙ্গাসন। প্রতিদিন যতবার যত বেশি সময় পারি, বঙ্গাসনে বসব। আর ভোরে উঠে দাঁত ব্রাশ করে অন্তত এক গ্লাস কুসুম গরম পানি খাবো। সাথে এক টুকরো লেবুর রস, এক চা চামচ মধু দিতে পারেন। তারপর যার যার ধর্মমতে প্রার্থনা করে কিছুক্ষণ হাঁটব। দেখব যে, দৌড়ে টয়লেটে ঢুকছি আর বের হচ্ছি, মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে। তারপর কয়েকটি যোগাসন ও মেডিটেশন করব। তারপর দান করে সকালের খাবার খেয়ে এনার্জি নিয়ে নেবো।

আমরা আলোচনার মূল বিষয়গুলোকে আবার একটু পয়েন্ট করে বলতে চাই :

  • রাত ১১টায় পারিবারিকভাবে সকল স্ক্রিন (ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন ইত্যাদি) বন্ধ করে দিয়ে ঘুম।
  • বিকেলবেলা চা-কফি যত না খান তত ভালো। বিশেষত বিকেলে কফি খাবেন না। কারণ কফির যে ক্যাফেইনের  প্রভাব ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত শরীরে থেকে যায়, গভীর ঘুম হয় না। এবং পৃথিবীতে যে জাতিগুলো কফি খায় বেশি, তাদের অনিদ্রার হার সবচেয়ে বেশি।
  • কায়িক শ্রম করতে হবে, দৈহিক পরিশ্রম করতে হবে। সেটা যেন সুন্দরভাবে করতে পারি এজন্যে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, যোগ ব্যায়াম করতে হবে। একজন বলছিলেন যেদিন তার ব্যায়াম করার সুযোগ তেমন হয় না, সেদিনও তিনি পাঁচটি আসন করেন। কীভাবে? সকালে নাশতার আগে প্রাণায়াম ও বঙ্গাসন, তারপর নাশতা করে বজ্রাসন, অফিসে যাওয়ার আগে স্বরায়ন, দুপুরে লাঞ্চের আগে শবাসনে শিথিলায়ন। আর যেদিন সময় পান ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট যোগ ব্যায়াম করেন। আর সুযোগ পেলেই হাঁটতে হবে। হাঁটুন, এতে যে যাতায়াত ভাড়া বেঁচে যাবে, তা দিয়ে বাদাম খান, ডাবের পানি পান করুন।
  • ভোরের মেডিটেশনে সারাদিনের কাজগুলো দেখা, তারপর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া। কাজের আগে মেডিটেশন খুব জরুরি। ধরুন, একদিন বললেন যে, আমি সারাদিন মেডিটেশন করব। না, আধা ঘণ্টা মেডিটেশন করেন। কিন্তু নিয়মিত করেন। আপনি একদিন ২৪ ঘণ্টা মেডিটেশন করে যা উপকৃত হবেন, আপনি যদি ৪৮ দিনে আধা ঘণ্টা করে মেডিটেশন করেন তাহলে তারচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন।

ইনশাআল্লাহ! এই চর্চায় আমরা সুস্থ থাকব, ভালো থাকব। তাহলে সুস্থ দেহের জন্যে আপাতত রাতে ঘুম, সকালের মেডিটেশন করে দান করে তারপর নাশতা আর বঙ্গাসন নিয়ে আমরা শৃঙ্খলাময় জীবন যাপন করতে থাকি। আশা করছি, সামনে শারীরিক ফিটনেসের আরো কয়েকটি জরুরি বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা পাব। সে পর্যন্ত এই তিনটি বিষয় আমরা চর্চা করতে থাকি। প্রভু যেন আমাদের চেষ্টায় বরকত দেন, আমাদেরকে সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন আর কর্মব্যস্ত সুখী জীবন যাপন করতে সাহায্য করেন-সে প্রার্থনা করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *